সম্পাদকীয় নোট: মোস্তাক আহমাদ দীনের কথা ও হাড়ের বেদনা কবিতার বইয়ের উপর হাফিজ রশিদ খানের আলোচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল হাবিবুররহমান এনার সম্পাদিত খোয়াব ছোটকাগজে, অক্টোবর সংখ্যা ২০০২ সালে।
মোস্তাক আহমাদ দীন বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কবিদের মধ্যে একটি উল্লেখনীয় পরিসর গড়ে তুলতে চলেছেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে, ওসবের পাতায় নিরন্তর কিছু নম্র-কর্ম কবিতা লিখে এ আয়তন তার প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। লেখাবাহুল্য: এ-লব্ধি তার কবিতাসমূহের অভিনিবেশ পাঠ থেকে অলক্ষ্যে উঠে-আসা বই নয়। কবিতার ভেতর থেকে সমস্ত উৎকাঙ্ক্ষা ও বিবমিষাকে উৎখাত করে একটা প্রকৃত মেদুর অথচ সনিষ্ঠ পরানগাথা মোস্তাক খোদিত করতে চলেছেন বাংলা কবিতায়। আমার মনে হয় আমাদের সময়ের কবিতা নিয়ে চোখ ঠারেঠুরে কথা বলা, ততোধিক উঞ্চবৃত্তিজাত কবিতাগত মানসিকতায় কুঁকড়ে-থাকা মানুষজনের জন্যে লিখে-আসা পঙ্ক্তিগুলো কোনোই তরঙ্গদোলা আনবে না বয়ে। অথচ এটির ঠিক বিপরীতে জাজ্বল্যমান প্রমাণ পাওয়া গেল মোস্তাক আহমাদ দীন-এর প্রথম কবিতার বই: কথা ও হাড়ের বেদনা পাঠের পরপর।
জীবনের যে নিহিত মূল্যবোধ ও পরাচেতনায় প্রকৃত শিল্পবোধের অধিষ্ঠান, তাই তো আসল সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের পোক্ত পাটাতন। সেখানেই বুনন চলছে বাংলা কবিতার নতুন তাঁতশিল্প, নব্বুইয়ের কবিদের হাতে। কবিতায় মেকি শব্দগুচ্ছ, গ্রন্থ পাঠজাত অজারিত আবেগের মাকু চালাচালির দিন পেরিয়ে নব্বুইয়ের কবিতায় সেই ধীমান রণন শোনা যাচ্ছে মোস্তাক আহমদ দীন-এর দৌলতে তার কথা ও হাড়ের বেদনায়
ক্যুরিয়ারে তার এ-কাব্য আমার ঘরের ভেতর উড়ে এলে, যারপরনাই স্বস্তির একটা হাওয়া বয়ে গেল আমার নিবাসের লোহার গ্রিল আর দরোজার গম্ভীর পাশ দিয়ে। এক নিশ্বাসে রাতভর তার কাব্যটি পাঠশেষে ভোরের দিকের ঠান্ডা বাতাসের মায়ায় আবারো আমি ফিরে আসি তার একটি কবিতার পাতায়:
ফিরে না আসতাম যদি এই পোড়োগৃহে, তবে
দূরে থেকে যেত প্রিয় মানুষের মুখ, তার গূঢ় প্রবাহ ছুঁয়ে
পরে ভালো লাগে প্রত্নমুখগুলি
অবশ্য আমি মানি জন্মগত রীতি
আমার কোনো কিছু ছুঁয়ে আছে মৃদুবিস্মরিত
মানুষের রক্ত কিংবা হাড়,
তবু গুরুত্ব দেব প্রিয় মানুষের মুখ
বিবিক্ত ভ্রমণ শেষে আগে আমি পেয়ে গেছি দুঃখ আর জরা
এইবার শুধু জাগে খনন পিপাসা
কে কোন প্রিয় বোধ নিয়ে কেবলি দূরের কথা বলে
এই মর্মে বোধি খুঁড়ে দেখি
থরে থরে গৌণ কিছু মেঘ পড়ে আছে
[মেঘ অথবা নিষিদ্ধ অংশ; পৃ : ১৫]
এভাবে তার কবিতার রথে ভর-করে আমার চোখেমুখে তখন স্বপ্নকুয়াশার তন্তু, তখন খেয়াল করি, এটি চলছে একবিংশ শতকের শুরুর পর্ব। কবিতার স্বপ্নসম্ভবা, উজ্জ্বলন্ত, নির্বিবাদী মুখে কালিমা মাখা হয়েছে অনেক। তত্ত্ব ও খেউড়ের মিশেলে। কবিতার কঙ্কালখণ্ড ও শ্মশানভূমিতে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ দেখতে পায়নি প্রবহমান জীবন্ত কবিতার ব্রতচারীদের। তারা অবলীলায় গৎবাঁধা অভিসন্দর্ভ করেন এই বলে যে: বাংলা কবিতার ভিত, বনেদিয়ানায় খাড়া হয়ে গেছে সে কবে। চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, বিহারীলাল, মাইকেল-রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ-শামসুর হয়ে। ৭০/৮০’র কবি ঋত্বিকগণ তো আছেনই। ভাবতে অবাক লাগে, এই প্রথাগত অভিসন্দর্ভ যারা করেন, কতো খাটো চোখ ও মন নিয়ে কবিতার গতি ও জীবনের পথকে দেখেন তারা। কবি ও কবিতার নামে তাদের পাথুরে কলমের একটি খোঁচায় খারিজ করে দেন সবকিছু। অথচ কবিতার অমৃতনিষ্যন্দী পরম্পরার মধ্যেই আমরা দেখি, রবীন্দ্রনাথের সব পেয়েছি’র দেশ থেকে ঠিকই তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে আসেন নজরুল, জীবনানন্দ। মায় বুদ্ধদেব বসু সুধীন দত্ত কি অমিয় চক্রবর্তী বা বিষ্ণু দে। ওই পাঁচপাণ্ডবের ঘেরাটোপও একদিন টুটে যায় পরবর্তীকালের ফররুখ-অরুণকুমার সরকারদের প্রাতিস্বিক টোকায়। কেননা ‘রাতভর ডাহুকের ডাক’ কিংবা ‘যৌবন যায় যৌবন জ্বালা যে যায় না’ যে ভাষিক দরদ ও অন্তর্জালাকে বের করে আনে তা নতুন। ওই কথিত বনেদিভিতের ঝোপ ভেঙে এরপরও মাঘনিশীথের কোকিলেরা গেয়ে ওঠেন: আল মাহমুদ কি আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ, রফিক আজাদ কি মোহাম্মদ রফিক হয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিংবা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর কলমের দাগে বাংলা কবিতার পাতায় যোগ হয় অনায়াসে অবিনাশী পংক্তিমালা: ‘তাতে আমাদের কতটুকু ক্ষতি, মিতে এসো তালি-দেওয়া জুতো জোড়ায় সযত্নে বাঁধি ফিতে’ (বীরেন্দ্র)।
৭০-এর চিলচেরা শব্দের হট্টগোলের ভেতর নিঃশব্দে আশির দশক এল কবিতার রাজকন্যেকে বন্দিদশা থেকে তুলে নিয়ে পুষ্পকরথে ভেসে। নিঃসন্দেহে কারণ, রাইফেলের ঠান্ডা নল আর বুটের বাখোয়াজে বাংলাদেশ তখন নীরবেই প্রস্তুত হচ্ছিল তখনকার বিদ্যমান অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ। আশির কবিগণও ওই হাঁকডাকের সামরিক দঙ্গল মাড়িয়ে নৈঃশব্দের স্থল-মাইন পোঁতার কাজটি সেরেছেন। সে জন্যে আশির কবিতার মূল ধারাটি ইতিহাস, প্রত্ন-মানবিক শিলালিপি পাঠ আর তথাকথিত নিচুবর্গের জনমানুষের লালিত্যময় দগদগে কাব্যপুরাণে ভাস্বর হয়েছে। সেই আশির দশকের কবিতায় এখনো বাকি রয়ে গেছে প্রকৃত সুলুকসন্ধান। অবশ্য এও স্বীকার্য যে, আশিরই কতিপয় লিটলম্যাগকেন্দ্রিক কর্মীর অকস্মাৎ কাব্যগত তত্ত্ব ও হুজুগের ডামাডোলে প্রকৃত কবিদের রচনাপাঠের চেয়ে তত্ত্বের দিকে নজর পড়েছে বেশি কারো কারো। এখন সেই উল্লম্ফনের মাঠে আর আলো নেই। মেলাশেষের করুণ সুর বাজছে যেন অন্ধকার মাঠ থেকে।
জীবনের যে নিহিত মূল্যবোধ ও পরাচেতনায় প্রকৃত শিল্পবোধের অধিষ্ঠান, তাই তো আসল সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের পোক্ত পাটাতন। সেখানেই বুনন চলছে বাংলা কবিতার নতুন তাঁতশিল্প, নব্বুইয়ের কবিদের হাতে। কবিতায় মেকি শব্দগুচ্ছ, গ্রন্থ পাঠজাত অজারিত আবেগের মাকু চালাচালির দিন পেরিয়ে নব্বুইয়ের কবিতায় সেই ধীমান রণন শোনা যাচ্ছে মোস্তাক আহমদ দীন-এর দৌলতে তার কথা ও হাড়ের বেদনায়। রূপদক্ষ এই তরুণের স্বরটি ভারি সান্দ্র ও স্বপ্নভারাতুর। রচিত হয়েছে তার কবিতায় এক দূর অদূরের সাঁকোমালা। মুহূর্তিক চঞ্চলতায় মোস্তাক ভেসে উঠতে নারাজ চোরাবালিসদৃশ কবিতার ওপরিতলের কারপেটে। অযথা স্পেস নষ্ট না-করে ১০৭টি কবিতায় গড়া কথা ও হাড়ের বেদনা-য় বিন্যস্ত কবিতাগুলো স্বপ্ন-কল্পনা আর স্ফারিত বাস্তবের অতলতাকে মস্তিষ্কে, অতপর বুকের গহনে নোঙর করিয়ে দ্যায়।
এই লেখা শেষ করা যাক মোস্তাকের শ্রাবণরাতের কানে কবিতাটি শুনতে শুনতে:
বরং কণ্টক দিও ঘোরগ্রস্ত আমার গলায়
তবুও শ্রাবণরাতের কানে তুলে দিতে বলিও না মিথ্যে রূপকথা
আমার এ ঋণের গল্প সম্পাদিত বিগত বর্ষায়।
এ বুকে লোকের ভয় তার চে আরো বেশি ভয় করি দিবসের আলো
এই কথা কী করে যে জেনে ফেলে ঘনঘোর শ্রাবণের রাত
ফলত এ ঘোরের রাতে ইভের কোটরে আমি বীজ রাখি আদিম আদম
লজ্জা ও ভয়ের কাঁটা খেয়ে নিল সেই বরিষণ
একান্ত বন্ধু হয়ে আজো খুব জেগে আছে শ্রাবণের রাত
আজ এই রাতের কানে মিথ্যেবিনা সত্য কথা পাঠ করে যাই
[কথা ও হাড়ের বেদনা; পৃ: ৫১]
কথা ও হাড়ের বেদনা
লেখক: মোস্তাক আহমাদ দীন
প্রকাশক: পাঠকৃতি
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০১ সাল।
কথা ও হাড়ের বেদনা বইটি কিনতে চাইলে
