শুধুমাত্র অর্থনীতি বা শুধুমাত্র ইতিহাসের আলোচনা কী হয়? ইতিহাসের মধ্যে থাকে রাজনীতি, সমাজনীতি, রাজা, প্রজা এবং অর্থনীতি। আবার অর্থনীতির মধ্যেও থাকে ইতিহাস পর্যালোচনা, মানুষ ও তার ক্রমঅগ্রসরতা। পুঁজিবাদী এক তাত্ত্বিক বলেছিলেন এরকম, ইতিহাস শেষ হয়ে গেছে। মানে হলো সমাজতন্ত্র যে বলে, পুঁজিবাদের পরে আসবে সর্বহারাদের সাম্যের সমাজ সেই আশায় গুড়ে বালি, ইতিহাসই যেহেতু শেষ তাই সাম্যের ইতিহাস শুরুর প্রশ্নই আসে না।
তবে আমরা যে পুঁজিবাদী সমাজে এখনও রয়ে গেছি তার উপর বিশ্বায়ন বা পণ্যায়নের মধ্যেই বিরাজ করছি তা তো সত্য এবং তা ক্রমশই বাড়ছে। আকবর আলি খানের পরার্থপরতার অর্থনীতি (২০০০) বইটিতে পুঁজি ও সাম্যবাদের বাঁধা বুলি এড়িয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যেসব অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে আমরা জীবন অতিবাহিত করি সেসব সমস্যার প্রকৃতি ও উত্তরণের চমৎকার বিশ্লেষণ দেখেছিলাম। আকবর আলি খানের আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি বইটিও হিউমার ও গভীরতায় তার পরার্থপরতার অর্থনীতি’র মতোই ক্লাসিকে রূপান্তরিত হয়েছে এতোকালে।
কিন্তু জ্ঞানের সব শাখার মতো অর্থনীতিও অনড় কিছু নয়, মূলধারার অর্থনীতি প্রতিনিয়তই বদলাচ্ছে। এই মূলধারার অর্থনীতিতে যেসব তত্ত্ব প্রসার তৈরি করেছে সাম্প্রতিক সময়পর্বে সেগুলো নিয়েই আকবর আলি খানের আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি বইটি। মূলধারার অর্থনীতি বলে যে একটি বিষয় আছে, সেটিতে পুঁজি বিদ্বেষ ও বিপ্লবের ঘোরে আমরা নজরই দিই না। আমারা দেখছি বর্তমানে সবকিছুকেই পণ্যে রূপদানের চেষ্টা চলছে। পন্যের বাইরে কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না। তবে প্রতিরোধও যে হচ্ছে না তা নয়, বাম বলয়ের বাইরেও হচ্ছে, কিন্তু সেই প্রতিরোধের জন্য সবকিছুর মতো অর্থনীতিকেও জানা প্রয়োজন। যাকে বলে মূলধারার অর্থনীতি তাকে জানা প্রয়োজন। অর্থনীতিতে বর্তমানে কী কী সংযোজিত হচ্ছে? কী অবস্থানে আছে? কী কী নতুন তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে চলেছে? সেসবের তরঙ্গ আমাদের এখানে বড়বেশি আসে না।
আকবর আলি খান এ নিয়ে তীক্ষ্ণ-তীর্যক, লক্ষ্যভেদী মন্তব্য করেছেন বইয়ের ভূমিকায়। সেখানেই অর্থনীতির হাল আমলের সংবাদ না আসার কারণ উল্লেখ করেছেন তিনি:
“প্রথমত, বাংলায় অনেক প্রবাদপ্রতিম অর্থনীতিবিদ জন্মগ্রহণ করেছেন। তবে এঁরা (সম্ভবত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মোহে) বাংল ভাষায় লেখার তাগিদ অনুভব করেননি। দ্বীতিয়ত, বাংলা ভাষায় অর্থনৈতিক পরিভাষার দৈন্য রয়েছে। তৃতীয়ত, জন্মগতভাবে বাঙালিরা বামপন্থী। বাংলায় অর্থনীতি নিয়ে যা প্রকাশিত হয়, তার সিংহভাগই হচ্ছে রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে ডান-বামের তরজা আর খিস্তি-খেউড়। আজ যাকে মূলধারার অর্থনীতি বলা হয় সে সম্পর্কে বাংলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নেহাত অপ্রতুল।” (আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি)।
সেই অভাব ঘোচাতেই লেখা হয়েছে আকবর আলি খানের আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি বইটি। তবে এর বদল ঘটছে; বাংলায় অর্থনীতি চর্চার চিত্রটি ক্রমশই বদলাচ্ছে। ২০২৪ সালে লেখক, প্রাবন্ধিক সনৎকুমার সাহার অর্থনীতির ন্যায়-অন্যায় বইটিতে আমরা মূলধারা ও সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক তত্ত্ব গড়ে ওঠার শর্তসহ গুরুত্বপূর্ণ দুই অর্থনীতিবিদ অমিয়কুমার দাশগুপ্ত ও নুরুল ইসলামের উপর বিশদ আলোচনা পেয়েছি। আর এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালে প্রকাশিত সেলিম জাহানের অর্থনীতি বিষয়ক বই বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ , এই বইটিতে সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশকে কেন্দ্রে রেখে আলোচনা রয়েছে। এমন আরো গুরুত্বপূর্ণ বই লেখা হচ্ছে ও তালিকাটি বাড়ছেই।
এখানে জন্মদিনের অর্থনীতি বলতেও যে একটা বিষয় অর্থনীতিতে থাকতে পারে সেটা আট নাম্বার প্রবন্ধের শিরোনামে দেখে আশ্চর্য ঠেকে। কিন্তু আমরা যারা দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষ তাদের কাছে জন্মদিনের সাথে রাজনীতি, ভোট, শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্ক অস্পষ্ট নয় মোটেই। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার যদি ২০২৫ এর ডিসেম্বরে জাতীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করে তাহলে যাদের জন্মদিন ১ জানুয়ারি এবং বর্তমান বয়স ১৭ বছর তারা বাদ পড়ে যাবে ভোট থেকে। আর ১ জানুয়ারিতে জন্মদিন এমন তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা কী বিশাল হতে পারে তা আমরা স্পষ্টভাবে জানি। জন্মদিনের অর্থনীতি ও রাজনীতির আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের বিদ্যালয়, চাকরির সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা বিষয়গুলোকেও নিয়ে এসেছেন।
আকবর আলি খানের আজব ও জবর আজব অর্থনীতি বইয়ে প্রবন্ধ আছে দশটি (অধ্যায় রয়েছে প্রতিটিতেই)। প্রবন্ধগুলো হলো, আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি, মিত্রপক্ষের গুলি: অনভিপ্রেত পরিণামের অর্থনীতি, সুখের লাগিয়া: সুখ ও অর্থনীতি, ভেগোলজি ও অর্থনীতি: ‘না মিথ্যা না সত্য’, সুকতলার অর্থনীতি ও জুতার রাজনীতি: অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তথ্যের ভূমিকা, শুভ জন্মদিন: জন্মদিনের অর্থনীতি ও রাজনীতি, সরকারের অপচয়: রাজনৈতিক অর্থনীতি, বিশ্বায়ন: একটি সমীক্ষা ও কয়েকটি অমীমাংসিত প্রশ্ন, বিশ্বায়ন ও বাঙালির সত্তার অন্বেষা: একদিন বাঙালি ছিলাম রে, বাংলাদেশে সিভিল সমাজ: বাস্তবতার সন্ধানে একটি ধারণা।
প্রবন্ধগুলোর শিরোনামে রাষ্ট্রকে যুক্ত করেছেন লেখক খুব কৌশলে। এখানে জন্মদিনের অর্থনীতি বলতেও যে একটা বিষয় অর্থনীতিতে থাকতে পারে সেটা আট নাম্বার প্রবন্ধের শিরোনামে দেখে আশ্চর্য ঠেকে। কিন্তু আমরা যারা দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষ তাদের কাছে জন্মদিনের সাথে রাজনীতি, ভোট, শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্ক অস্পষ্ট নয় মোটেই। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার যদি ২০২৫ এর ডিসেম্বরে জাতীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করে তাহলে যাদের জন্মদিন ১ জানুয়ারি এবং বর্তমান বয়স ১৭ বছর তারা বাদ পড়ে যাবে ভোট থেকে। আর ১ জানুয়ারিতে জন্মদিন এমন তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা কী বিশাল হতে পারে তা আমরা স্পষ্টভাবে জানি। জন্মদিনের অর্থনীতি ও রাজনীতির আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের বিদ্যালয়, চাকরির সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা বিষয়গুলোকেও নিয়ে এসেছেন।
আবার, সুখ ও অর্থনীতিতে “সুখ ও রাজনৈতিক পরিবেশ” এবং সুখের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্পর্ক দেশ ও আন্তার্জাতিক পরিসর বিবেচনায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। “সুকতলার অর্থনীতি ও জুতার রাজনীতি”তে সেখানে তথ্যের ও ব্যক্তির ভূমিকা কতখানি সেটি তুলে ধরেছেন। তথ্য কোনো সাধারণ বিষয় নয়, আর সব তথ্যই যে সঠিক এমনও নয়, কীংবা যদি সঠিকও হয় তা আবার প্রয়োজনীয় নাও হতে পারে। তথ্য আবার ভুলপথে চালিত করার মাধ্যমও হতে পারে।
সরকারের অপচয় নিয়ে আলোচনায় প্রথমেই তিনি অপচয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে চেয়েছেন। কারণ সরকার যা খরচ করে সেগুলোতে অপচয় কোনগুলি? এটা জানা না থাকলে যেকোনো ব্যয়কেই অপচয় মনে হতে পারে। এই লেখার প্রথমে উল্লেখ করা অর্থনীতির মধ্যে থাকা ইতিহাস, মানুষ, রাজনীতির বিষয়গুলোকে আমলে না নিলে বিষয়টির আলোচনা গতি পায় না, সম্পূর্ণ হয় না, এটি খুব ভালোভাবে দেখা যায় “বিশ্বায়ন ও বাঙালির সত্তার অন্বেষা” প্রবন্ধে। বিশ্বায়ন মানে কী? এর মানে হলো ভোদভেদ মুছে দেওয়া, জাতিগুলোর স্বাতন্ত্র নিশ্চিহ্ন করেই পণ্য তার বাজার খুঁজে নেয়। কিন্তু পরিচয় মুছে গেলে থাকে কী? এখানেই সত্তার অন্বেষণের বিষয়টি আসে। প্রবন্ধটিতে বাঙালি সত্তার ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক বিষয়আশয়ের গভীরে তাকিয়েছেন লেখক। এরপর আছে বাংলাদেশের সিভিল সমাজের বিস্তারিত ভূমিকা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা।
আকবর আলি খানের আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি বইটি সাহিত্যগুণযুক্ত। যেকোনো কঠিন তত্ত্বকেই সাহিত্যরসে ভিজিয়ে পরিবেশন করেন তিনি, এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। সাহিত্যে যাকে শিল্পরস বলা হয় তার সবই পাওয়া যায় তার লেখায়। তবে মূল আলোচনা থেকে বিচ্যুত হয়ে নয় অবশ্যই। এই বইয়ের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় সহজভাবে বিশ্বের প্রভাব বিস্তারী অর্থনীতির তত্ত্বগুলোকে জানার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। আগ্রহীজনদের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটানোর পাশাপাশি পাঠতৃপ্তি দেবে এই বই।
আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি
লেখক: আকবর আলি খান
বিষয়: অর্থনীতি
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ ২০১৩, সপ্তম মুদ্রণ ২০১৬
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
মূল্য: ৬০০ টাকা।
আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি বইটি কিনতে চাইলে
