বাহিরানা

আলভী আহমেদের অনুবাদে হারুকি মুরাকামি: সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা ও স্মৃতিকথা—অন্য এক মুরাকামি


জাপানি ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার হারুকি মুরাকামি তার লেখালেখির ভিন্ন আঙ্গিকের জন্য জাপানের বাইরে বিখ্যাত হলেও তার স্বদেশ জাপানে সমালোচিতও। তাকে প্রায়শই লেখালেখিতে প্রথাগত জাপানি ঐতিহ্য অনুসরণ করেন না বলে সমালোচনা শুনতে হয়। এক্ষেত্রে তার সঙ্গে মিল রয়েছে আর্হেন্তিনার কথাসাহিত্যিক ও কবি হোর্হে লুইস বোর্হেসের। বোর্হেস তার প্রতি আর্হেন্তিনার ঐহিত্য অনুসরণ করছেন না বলে যে অভিযোগ, তার জবাব দিয়েছেন বিভিন্ন সময়, এর মধ্যে একজন স্বদেশি লেখকের লেখার একটি অংশ তুলে ধরে তিনি দেখিয়েছিলেন ওই লেখক বর্ণনাটি যে ভাবে, যে আঙ্গিকেই দেন না কেন, তিনি যে একজন আর্হেন্তিনীয় সেটা ধরা পড়বেই। এর অর্থ হলো লেখার পেছেনে জাতিগত, দেশগত, সংস্কৃতিগত বিষয়গুলো অস্বীকার করে যেমন সমালোচনা হয় না, তেমনি লেখক লেখার সময় বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন না থাকলেও তার লেখায় তা ধরা পড়বে। মুরাকামির ক্ষেত্রেও সেটা সত্য, তিনি যে জাপানি সেটা আমরা তার লেখার ইংরেজি অনুবাদ থেকে অনূদিত বাংলা পড়েও বুঝতে পারি। কীভাবে পারি সেটা বিস্তারিত বলা এখানে সম্ভব নয়, তবে মুরাকামির শত্রুদের কাছেও তাকে একজন ফরাসি ঔপন্যাসিক বা ব্রিটিশ কীংবা আমেরিকান ঔপন্যাসিক মনে হবে না।

“আমি বরাবরই ডিমের পক্ষে” বলার সাহস মুরাকামির রয়েছে, ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি তার এই সমর্থন কিন্তু তিনি তাদের দেশের দখলদারদের সভাতেই বলেছিলেন, সেই অত্যন্ত চমকপ্রদ ও সাহসী বক্তৃতাটিও পূর্ণাবয়বে এই বইটিতে স্থান পেয়েছে।

তবে তার জীবন ও লেখার দর্শন অনেকটাই ইউরোপবাহিত এও অস্বীকার করার উপায় নেই। এটা অবশ্য ভালো না খারাপ সেটা আমি বলতে চাই না, তবে তা তাকে কিছুটা ইউরোপীয় সাহিত্যের অংশ করে তুলে। তার অনেক ছোটগল্পেই যে বিচ্ছিন্নতার দেখা মেলে, তা ইউরোপীয়, যেমন, তার কিনো নামে গল্পটি, এর প্রধান চরিত্রের বিচ্ছিন্নতা পাশ্চাত্যের কিন্তু যখন একই গল্পে তিনি জাপানী লোকপুরাণের উল্লেখ করেন তখন তিনি ইউরোপের সঙ্গে জাপানকে ব্লেন্ড করে মুরাকামি হয়ে ওঠেন। যা তার সব সাহিত্যকর্মেই পাওয়া যায়। ফলাফল তিনি ইউরোপ ও জাপান দুইখান থেকেই বিচ্ছিন্ন কিন্তু একসঙ্গে স্বতন্ত্র হয়ে যান। তার কথাসাহিত্যকে এভাবে দেখা যায়, যে, তা দুইটি সভ্যতার মিশ্রণ। ইউরোপীয় সাহিত্যও তার প্রিয়, তার দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস প্রকাশের পর এনপিআরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুরাকামি বলেছিলেন, স্কট ফিটজেরাল্ড তার প্রিয় ঔপন্যাসিক, এবং তার দ্য গ্রেট গেটসবি জাপানি ভাষায় অনুবাদও করেছিলেন মুরাকামি।

এখানে আমাদের উল্লিখিত সাক্ষাৎকারের মতোই মুরাকামি তার জীবনে এখন পর্যন্ত কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, কিছু বক্তৃতাও। সেইসব সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতা নিয়ে আলভী আহমেদের অনুবাদে হারুকি মুরাকামি: সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা ও স্মৃতিকথা বইটি বাংলা অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে। আলভী আহমেদ মুরাকামির নরওয়েজিয়ান উড অনুবাদ করেছিলেন, সেই অনুবাদটি পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছিল। বর্তমান বইটিতেও তার ধারাবাহিকতা রয়েছে। এই সাক্ষাৎকারগুলো, স্মৃতিকথা ও বক্তৃতাগুলোতে মুরাকামি কী দ্বারা তাড়িত হন, কী তাকে ভাবিত করে, সঙ্গীত ও জ্যাজ তাকে কেমন প্রভাবিত করে সেসব পাওয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসবের বাইরেও ভিন্ন কিছু পাওয়া যাবে। তা হলো তিনি নির্যাতিত মানুষকে কীভাবে দেখেন, ক্ষমতাকে কীভাবে দেখেন। “আমি বরাবরই ডিমের পক্ষে” বলার সাহস মুরাকামির রয়েছে, ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি তার এই সমর্থন কিন্তু তিনি তাদের দেশের দখলদারদের সভাতেই বলেছিলেন, সেই অত্যন্ত চমকপ্রদ ও সাহসী বক্তৃতাটিও পূর্ণাবয়বে এই বইটিতে স্থান পেয়েছে।

বইটিতে রয়েছে তিনটি সক্ষাৎকার, “ডেবোরাহ ট্রিজম্যানের মুখোমুখি: দ্য নিউ ইয়র্কার ফ্যাস্টিভ্যাল”, “‘লিবারেশন’ ইন্টারভিউ করোনাকালে কেমন কাটছে তার জীবন”, “‘প্যারিস রিভিউ’ ইন্টারভিউ আর্ট অব ফিকশন”, দুইটি বক্তৃতা, “কাতালুনিয়া আন্তর্জাতিক পুরস্কার: তোমরা শান্তিতে ঘুমাও, এই ‍ভুল আমাদের আর কখনও হবে না”, “জেরুজালেম পুরস্কার: আমি বরাবরই ডিমের পক্ষে”, দুইটি স্মৃতিকথা, “লেখা শুরুর গল্প: আমরা ‘কিচেন টেবিল ফিকশন’ জন্মের ইতিকথা” “বার্থডে অনার: আ ট্রিবিউট ফ্রম মুরাকামি”।

এই সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতাগুলো প্রত্যেকটির মধ্যেই সময়ের ব্যবধান রয়েছে দীর্ঘকালের। ফলে এগুলোতে মুরাকামির চিন্তার পরিবর্তনও ধরা পড়ে স্পষ্টভাবে। তিনি প্রতিবছরই নতুন বই প্রকাশ করেন না, তার লেখার প্রক্রিয়াটি কী? কত সময় লাগে একটি বই লিখতে? যেমন, প্রথম সাক্ষাৎকারে ট্রিজম্যানের মুরাকামির কিলিং কমান্ডেন্টর উপন্যাসের এক লোক ও তাকে ছেড়ে যাওয়া তার স্ত্রীকে নিয়ে একটি প্রশ্নের জবাবে মুরাকামি, আমাদেরকে বইটি সম্পন্ন করার সময়সীমা ও প্রক্রিয়টিও বলেন, “বইটি বেশ মোটাসোটা। লিখতে আমার দেড় বছর লেগেছে। শুরুটা কিন্তু হয়েছিল ছোট ছোট দুটো প্যারাগ্রাফ দিয়ে। প্যারাগ্রাফ দুটো লিখে দেরাজের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। এবং একসময় ভুলেও গিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন হলো কি, আমি বুঝতে পারলাম ওই প্যারাগ্রাফ থেকে আমি একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারি। এবং প্রায় সাথে সাথেই লিখতে বসে গেলাম।” (হারুকি মুরাকামি: সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা ও স্মৃতিকথা, অনুবাদ, আলভী আহমেদ)

তার উপন্যাসটি দুই প্যারা দিয়ে শুরু হওয়ার পর দীর্ঘদিন পড়ে ছিল ড্রয়ারে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে যখন তিনি মনস্থির করলেন উপন্যাসই লিখে ফেলবেন, তখন তার সেটি শেষ করতে সময় লেগেছে দেড় বছর। আমাদের ঈদ সংখ্যাগুলোর উপন্যাস শেষ করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যেতে পারে ব্যাপারটি। আর ওই একই সাক্ষাৎকারে তিনি তার সংগীতপ্রীতি, ও তার উপন্যাসের চরিত্রদের সংগীতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন, তার দর্শনের মতো এখানেও পাশ্চাত্যের আধিক্য, যেমন, অপেরা, জ্যাজ। তিনি বলেন, “আমি যখন লিখি তখন মিউজিক শুনি। তাই মিউজিক ব্যাপারটা আমার লেখায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে চলে আসে।”, আবার,

“ট্রিজম্যান: সংগীত তাহলে আপনার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী?

মুরাকামি: হ্যাঁ। সংগীত এবং বিড়াল। এ দুটো জিনিস আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।” (ঐ)

আর প্রথম অংশটির অনুবাদে পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন আলভী আহমেদের “দেরাজ” শব্দটির ব্যবহার, শব্দটির এরকম মোক্ষম প্রয়োগে গোটা অংশটিরই ঔজ্জ্বল্যপ্রাপ্তি ঘটেছে। মুরাকামির বই এবং কথা সাধারণ ইংরেজিতে অনুবাদ করা যায়, এবং তা বাংলাতেও প্রযোজ্য, কিন্তু এই সাধারণ ভাষা কিন্তু অর্থগতভাবে নয়, তা গঠনগত, যা কার্যত সাধারণ নয় কিন্তু পড়তে আরামদায়ক। তাই অনুবাদক যদি সৃষ্টিশীল বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচিত না থাকেন, তাহলে ভালো অনুবাদ হতে পারলেও সেখানে তার মুন্সিয়ানা দেখানো সম্ভব নয়। আলভী আহমেদ সৃষ্টিশীল বাংলায় মুরাকামির সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা ও স্মৃতিকথার অনুবাদ করেছেন।

হারুকি মুরাকামি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক, নোবেল পান না নাইবা পান, তাতে তার লেখায় আগ্রহীদের তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু তিনি যে বিশ্বসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ লেখক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেটা তার জনপ্রিয়তা দিয়ে মাপার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ যেমন বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় ছিলেন, মুরাকামির জনপ্রিয়তাও বিশ্বের পাঠক সমাজে সেরকম। তাদের দুইজনের আরেকটি মিল রয়েছে তা হলো তাদের ভাষা ব্যবাহার সহজ ও জটিলতাহীন। তবে গভীরতায় তা অসাধারণ। আলভী আহমেদের অনুবাদে হারুকি মুরাকামি: সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা ও স্মৃতিকথা বইটি পাঠকদের ভালো লাগবে।

হারুকি মুরাকামি: সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা ও স্মৃতিকথা
মূল: হারুকি মুরাকামি
অনুবাদ: আলভী আহমেদ
বিষয়: সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা, স্মৃতিকথা
প্রকাশক: বাতিঘর
প্রকাশকাল: ২০২২
মূল্য: ৩৫০ টাকা।

হারুকি মুরাকামি: সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা ও স্মৃতিকথা বইটি কিনতে চাইলে


মন্তব্য করুন