বাহিরানা

কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল: রাশিয়া, ঔপনিবেশিক ভারত থেকে বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র


জয় সেন
(সর্বশেষ আপডেট ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫)

পৃথিবীতে দর্শন, অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্রের বিশ্লেষণে যত বই প্রকাশিত হয়েছে কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল বা পুঁজি বইটি তার মধ্যে অন্যতম ও বিশেষ। মার্ক্সের জন্ম হয়েছিল জার্মানির প্রুশিয়ার রাইন প্রদেশে ০৫ মে ১৮১৮ সালে, মৃত্যুবরণ করেন ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে ১৮৮৩ সালে। তিনি ছিলেন একাধারে অর্থনীতিবিদ, ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক। পুঁজি গ্রন্থের বাইরে তার একটি যৌথ গ্রন্থ রয়েছে যা পৃথিবীখ্যত বরং পুঁজির চেয়েও বেশি। সেটি হলো কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো, যেটি তিনি তার আজীবনের বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে যৌথভাবে লিখেছিলেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৮ সালে। ডাস ক্যাপিটাল প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৭ সালে যখন কার্ল মার্ক্স জীবিত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর এর দ্বীতিয় ও তৃতীয় খণ্ড যথাক্রমে ১৮৮৫ ও ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত হয় বন্ধু, সহযাত্রী ও সহকর্মী ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সম্পাদনায়।

প্রকাশের পর থেকে এখন পর্যন্ত কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল বইয়ের প্রভাব প্রতি কালেই নতুন নতুন চিন্তক, সমাজ ও রাষ্ট্র বদলে আগ্রহীজন এবং সাহিত্যিকদের—প্রেরণা ও নতুন ভাষ্য নির্মাণে রসদ যুগিয়ে যাচ্ছে। বলা ভালো, বইটি প্রকাশের আগে ও পরে মানুষের জ্ঞান আর একইরকম থাকেনি। এঙ্গেলসের সঙ্গে মিলে কার্ল মার্ক্স যে বৈপ্লবিক তত্ত্বের সূচনা করেছিলেন যেখানে—পুঁজি ও কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো—রয়েছে তাকে বলা হয় মার্ক্সসিজম। কালে কালে যা বিভিন্ন বিপ্লবীর হাতে সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম বলে পরিচিতি পেয়েছে।
আধুনিক ‍যুগকে পুঁজিবাদী যুগ বলা হয়। মানব সভ্যতা ইতিহাসের এই পর্যন্ত আসতে আদিম সাম্যবাদ, দাস ব্যবস্থার যুগ, সামন্তবাদ পাড়ি দিয়ে পুঁজিবাদী স্তরে উপনীত হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদ বললেও পুঁজির চরিত্র আসলে কীরকম? সেটি কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল প্রকাশের আগে কেউ ধরতে পারেনি। তিনিই প্রথম পুঁজির গঠন, প্রবণতা ও আত্মধ্বংসী রূপ ব্যাখ্যা করেছেন তিন খণ্ডের এই বইয়ে।

কার্ল মার্ক্সের ইতিহাস দর্শন: উৎপাদনকাঠামো ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ

কার্ল মার্ক্সের দর্শনের মূল ভিত্তি হলো দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, তার ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের ইতিহাস দর্শনও তাই। মানবেতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, এই দ্বন্দ্বের ভিত্তিতেই সমাজের ও ইতিহাসের পরিবর্তন হয়। আর এই প্রক্রিয়াকেই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলা হয়। উদাহরণ হিসেবে, ষোড়শ শতাব্দীতে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে বর্জোয়াদের যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেটি ছিল সামন্তশ্রেণী ও পুঁজিপতিশ্রেণীর দ্বন্দ্ব। আরো গভীরভাবে বললে সামন্তীয় উৎপাদন কাঠামো ও পুঁজিবাদী উৎপাদন কাঠামোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব। মোটকথা বর্জোয়াদের উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে দ্বন্দ্বে সামন্তীয় উৎপাদন পদ্ধতি টিকতে পারেনি।

শ্রেণীদ্বন্দ্ব থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব

এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদই কার্ল মার্ক্সের পুঁজি (Das Kapital)-এর মূল বিষয়। মার্ক্স এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নিয়েছিলেন জার্মানির আরেক দার্শনিক হেগেলের কাছ থেকে। তাই মার্ক্সের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বুঝতে হেগেল পাঠও অত্যাবশ্যক। সমাজতন্ত্র এবং এর সফলতা দাঁড়িয়ে আছে এই দ্বন্দ্বের উপর, যাকে শ্রেণীদ্বন্দ্ব বলি আমরা। সব তন্ত্রের মধ্যেই দ্বন্দ্ব রয়েছে যেমন মার্ক্সের মতে পুঁজিবাদী সমাজে শ্রেণী আছে দুইটি, এক উৎপাদক বা পুঁজিপতি শ্রেণী, দুই, শ্রমিকশ্রেণী। পরবর্তীতে এর ব্যাখ্য দেব আমরা। প্রকৃত কথা এই যে, উৎপাদনকাঠামো, ইতিহাস, শ্রেণীদ্বন্দ্ব থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সবকিছুই ডাস ক্যাপিটাল বইয়ের সূত্র মেনে চলেছে। মার্ক্সীয় বিভিন্ন তাত্ত্বিক, বিপ্লবী তাদের মধ্যে ভ্লাদিমির লেলিন, আন্তোনিও গ্রামসি, মাও সে-তুং প্রমুখ রয়েছেন তারা এই বইটিকেই বিভিন্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যখ্যা দিয়েছেন, সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন পরিস্থিতিতে এর ব্যবহারযোগ্য ভাষ্য নির্মাণ করেছেন।

দ্বন্দ্বের রহস্য ও শ্রেণীর ছল বুঝতে কার্ল মার্ক্সের পাশাপাশি একদম শুরুতে পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনীতির উপর প্রথম গ্রন্থ, এরিস্টটলের পলিটিক্স পাঠও কী কম গুরুত্ববহ? এরিস্টটল বর্ণিত ধনিকতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সঙ্গে কার্ল মার্ক্সের সমাজতন্ত্রের পার্থক্য বুঝতে এই বইটিও ভলোরকমের রসদ দিতে পারে আমাদের এখনও। যেমন, এরিস্টটল আমাদের জানাচ্ছেন গণতন্ত্রে সাধারণের অংশগ্রহণ থাকে ক্ষমতকাঠামোতে, ধনিকতন্ত্রে সেই অধিকার থাকে শুধু ধনিকদের। তবে, আধুনিক পৃথিবীতে নতুন এক তত্ত্বে আমরা দেখতে পাই সমাজতন্ত্রে ক্ষমতাসীন হয় শ্রমিকেরা।

বর্তমান পৃথিবীতে বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশে যে গণতন্ত্র দেখতে পাই, সেগুলো ছদ্মবেশী গণতন্ত্র। এরিস্টস্টলের প্রকৃত গণতন্ত্র নয় সেগুলো। এগুলোকে গণতন্ত্র বলা হলেও আদতে গণের ক্ষমতা রয়ে গেছে ধনিকশ্রেণির হাতেই। সমাজতন্ত্র শ্রমিকশ্রেণীর মাধ্যমে এই সাধারণ জনগণের কাছেই ক্ষমতা নিয়ে আসে। যদিও বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, বর্তমানে তা খুঁড়িয়ে হাঁটছে। ভুলগুলো শুধরে উত্তরণের পথ প্রয়োজন। এসবের উৎস বইয়ের বাইরে কেউ পুঁজি বইটি পড়তে চাইলে বলা ভালো, ডাস ক্যাপিটাল সাধারণ পাঠকদের পড়া সহজসাধ্য নয়, এ কারণে বইটির ‍পাঠ সহায়ক গ্রন্থ প্রয়োজন। এ বিষয়ে অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে, যা ক্রমবর্ধমান। এর মধ্যে মাইকেল ওয়েইনের কার্ল মার্ক্স-এর ডাস ক্যাপিটাল: পাঠ প্রবেশিকা একটি। পুঁজি পড়ার আগে এই বইটি পড়ে নিলে অনেক কঠিন বিষয়ই সহজ হবে। বইটি বাংলাতেও অনূদিত হয়েছে।

ডাস ক্যাপিটালের মূল বিষয়বস্তু

এবার আসা যাক কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটালের মূল বিষয়বস্তুতে। ডাস ক্যাপিটালের মূল বিষয় হচ্ছে শ্রমের উদ্বৃত্ত তত্ত্ব। একটি পণ্য উৎপাদনের জন্য শ্রম প্রয়োজন হয়, শ্রমের মাধ্যমে কিছু বিচ্ছিন্ন উপাদান একটি পণ্য হয়ে ওঠে এবং এর ফলে সেটি বিক্রয়যোগ্য হয়ে মুনাফা তৈরি করে। শুনতে অদ্ভুত শোনালেও, সেই মুনাফার সিংহভাগই যে শ্রমিকেরা শ্রম দিয়েছে তাদের কাছে না পৌঁছে পণ্যের মালিক মানে পুঁজিপতির কাছে চলে যায়। এই ফাঁকিটাই হচ্ছে মোটা দাগে পুঁজিবাদ। এই ফাঁকি থেকে অর্থ ও সম্পদের একটা ব্যবধান তৈরি হয় সমাজ-রাষ্ট্রে। আর তার ফলেই উৎপত্তি হয় ধনীকশ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণীর। এইকারণেই পূর্বে বলা, পুঁজিবাদী সমাজে মূল শ্রেণী হচ্ছে দুইটি, এক, শ্রমিক শ্রেণী যাদের শ্রমে পণ্য উৎপাদিত হয়, দুই, মালিক শ্রেণী, যারা অর্থ বিনিয়োগ করে মুনাফার বড় অংশ শ্রমিকদের বঞ্চিত করে নিজেরা কুক্ষিগত করে পুঁজিপতি হয়।

পুঁজি প্রথম খণ্ডের অনেকাংশজুড়েই সাম্রাজ্যবাদ, উৎপাদন প্রক্রিয়া ও শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন কার্ল মার্ক্স। ব্রিটেনের শ্রমিকদের প্রতি কারখানা মালিকদের কৃত অন্যায্যতার বিষয়টিও এসেছে তার আলোচনায়। দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম অংশের মূল আলোচ্য বিষয় পুঁজির পরিভ্রমণ বা চক্রায়ন। পুঁজি কীভাবে ঘূর্ণনের মাধ্যমে শ্রমিকশক্তি, উৎপাদন ও বিক্রিত দ্রব্যের চক্রে নিজেকে পুনরুৎপাদন করে—তাতে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে এই খণ্ডে। দ্বিতীয় খণ্ডের দ্বীতীয় অংশের আলোচ্য বিষয়, পুঁজির টার্নওভার নিয়ে, উৎপাদন থেকে বিক্রয় পর্যন্ত যে সময় ব্যয় হয় সেটিকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এখানে। তৃতীয় খণ্ডের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে পুঁজির উৎপাদন প্রক্রিয়ার সামগ্রিক একটা চিত্র তৈরি করা। এই খণ্ড সাতভাগে সমাপ্ত হয়েছে।

কার্ল মার্ক্স আমাদের দেখিয়েছেন, পুঁজির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি আত্মধ্বংসী, কারণ এটা অনেকটাই দাস ব্যবস্থার মতো। পুঁজি সর্বগ্রাসীও, কিন্তু তার দু্র্বলতা হচ্ছে শ্রমীকশ্রেণী ছাড়া সে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পারে না। আর তার প্রাণভোমরা শ্রমিকশ্রেণী যখনই মুনাফা বিতরণের অন্যায্য পদ্ধতি বিষয়ে সচেতন হয় তখনই তারা বিদ্রোহ করে। সেই দ্রোহ চলমান এখনও।

সমাজতন্ত্র: ঔপনিবেশিক ভারত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ

এখন আমরা দেশে দেশে কার্ল মার্ক্সের আলোকে সমাজতন্ত্র বিষয়ে একটু আলোকপাত করতে পারি। মার্ক্সের পুঁজি ও কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো থেকে সমাজতন্ত্রে এই বিষয়টই গুরুত্বসহকারে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে সব দেশের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ একইরকম নয়। কারণ প্রতিটি দেশেরই সমাজের গঠন, ভৌগোলিক অবস্থান ও ইতিহাস ভিন্ন। তাই কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো আর পুঁজি আত্মস্থ করলেই দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে এটা ভুল ধারণা। এর জন্য জানা প্রয়োজন সেই দেশের ইতিহাস, ভৌগোলিক অবস্থান, গঠন ও সেটি ইতিহাসের কোন স্তরে আছে। কার্ল মার্ক্স নিজেও তার বিভিন্ন লেখাপত্রে দেশে দেশে উৎপাদন কাঠামোর ভিন্নতার বিষয়টির কথা বলেছেন। বলে রাখা প্রয়োজন উৎপাদন কাঠামোই একটি দেশের সমাজ ব্যবস্থার স্তর নির্দিষ্ট করে দেয়। যেমন, সামন্তীয় উৎপাদন কাঠামো, দাসব্যবস্থার উপৎপাদন কাঠামো ইত্যাদি। তাই সমাজতন্ত্রে উৎপাদন কাঠামো— সমাজের উপর কাঠামো ও ভেতর কাঠামো—জানা খুবই দরাকারী বিষয়। এপ্রসঙ্গে আমরা ব্রিটিশ ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তরের দীর্ঘ পথযাত্রায় থাকা মার্ক্সসিজমের ইতহাসও বিবেচনায় নিতে পারি। এই ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অংশ জানাতে ১৯৭১ পূর্ব বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের যুদ্ধপূর্ব বাঙলাদেশ একটি অসাধারণ বই। তিন নিজে বামপন্থী ফলে সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেই তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ এর মার্চের ২১ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের সব উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিশ্লেষণ হাজির করেছেন বইটিতে। বাংলাদেশে ১৯৭১ এর পর সমাজতান্ত্রিক সরকার কেন প্রতিষ্ঠিত হতে পারল না তার উত্তর পাঠকেরা এই বইটিতে পাবেন। মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ও কৃষক সমিতির অবদানও জানাটা প্রয়োজনীয়। এ বিষয়ে মওলানা ভাসানীর আত্মজীবনী বইটি ভালো ইতিহাস জানাতে পারে আমাদের।

সমাজতন্ত্র বা মার্ক্সসিজ দাবানলের মতো দেশে দেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে ব্রিটিশ ভারতও নয়। এখানে নীপিড়িত জনতা সমাজতন্ত্রে আশার আলো খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেস, মুসলিম লীগ—যাদেরকে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক পলিটিকাল পার্টি অব ইন্ডিয়া বইতে দেখিয়েছেন, সেগুলো রাজনৈতিক দল নয়। একটি রাজনৈতিক দল হতে গেলে গেলে যেসব শর্তের প্রয়োজন তা সেগুলোর ছিল না, এই শর্তগুলোর মধ্যে প্রথমেই পড়ে স্বাধীনতা ও স্বাধীন জনগণ, এরপর পজিটিভ লক্ষ্য। এসবের কোনোটিই ছিল না কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের। ফলে অনেক প্রগতিশীল স্বাধীনতাকামী মানুষেরা এসব দলের বাইরে মার্ক্সিজম বা সমাজতন্ত্রে আশ্রয় খুঁজেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক বির্বতনে বামপন্থার অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বামপন্থার বাস্তব অবস্থা জানতে ও সমাজতন্ত্রের উপর বইয়ের কথা বললে দীর্ঘকাল আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি করে আসা বামপন্থী লেখক, সমাজ বিশ্লেষক রইসউদ্দিন আরিফের প্রবাহিত জীবনের গল্প বইটিও আমাদের বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রের অবস্থার কথা জানায়। বইটি আত্মজৈবনিক হলেও যেহেতু স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে সব বড় আন্দোলনই তিনি দেখেছেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। বইটিতে সেসব নিয়ে এসেছেন তিনি। সেই সূত্রে একাত্তরপূর্ব বাংলাদেশে মানুষের মনে সমাজতান্ত্রিক চেতনা ও পুঁজির দৌরাত্ম কেমন ছিল আমাদেরকে বিশদভাবে তা জানাতে পারে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বই, ১৯৭১ পূর্ব বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের যুদ্ধপূর্ব বাঙলাদেশ বইটি। তিন নিজে বামপন্থী, ফলে সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেই তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ এর মার্চের ২১ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের সব উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিশ্লেষণ হাজির করেছেন বইটিতে। বাংলাদেশে ১৯৭১ এর পর সমাজতান্ত্রিক সরকার কেন প্রতিষ্ঠিত হতে পারল না তার উত্তরও আমরা অনায়াসে পেয়ে যাই। কারণ মূলস্রোতের সব রাজনৈতিক দলের পেছনেই ছিল পুঁজির কারসাজি।

কার্ল মার্ক্স ও লেলিনের মতে সমাজতন্ত্র শুধু একদেশে প্রতিষ্ঠিত হলে সেটি টিকে থাকতে পারে না। সেইসূত্রে সমাজতন্ত্রের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অর্জন রাশিয়ার ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের কথা অবশ্যই আসবে। লেলিন রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক নেতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষমতা দখলের বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে আসা প্রগতির বইয়ের কথা কী আমরা ভুলে গেছি। এই প্রগতি প্রকাশন ছিল বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার প্রকল্পেরই অংশ। রাশিয়া শুরু থেকেই ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ হটাতে উপনিবেশিক ভারতের জনগণের সাথে ছিল। সেটি বাংলাদেশে হওয়ার পরেও বর্তমান ছিল। সেই রুশ বিপ্লব—যেটি অক্টোবর বা বলশেভিক বিপ্লব নামে পরিচিত—নিয়ে আমাদেরকে রইসউদ্দিন আরিফের অক্টোবর বিপ্লব ও রুশ সমাজতন্ত্রের পুনর্পাঠ বইটি বিশেষ সাহায্য করতে পারে। রইসউদ্দিন আরিফ আমাদেরকে ঐতিহাসিক রুশ অক্টোবর বিপ্লবের নাড়ীতে নিয়ে গেছেন এই বইয়ের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত শ্রমিকশ্রেণীর সবচেয়ে বড় বিপ্লব হিসেবে ইতিহাসে এর দায় ও অর্জন সবই গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে সমাজতন্ত্রের বৈশ্বিক পরিস্থিতি, দেশে দেশে বিপ্লব, পতন ও উত্তরণের ইতিহাস নিয়ে হায়দার আকবর খান রনোর বিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ বইটিও গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যদিকে সেই সূত্রেই বলা যায় অক্টোবর বিপ্লবের পর বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ হঠাতে রুশ দেশে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের একবিপ্লবীও। গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী নামে সেই পাবনার ইশ্বরগঞ্জে ১৮৯২ সালে জন্ম গ্রহণ করেছিনে। জন্ম এবং স্টালিনের আমলে ট্র্যাজিক মৃত্যুবরণ করেছিলেন। শুধু তিনিই নন, তার সঙ্গে আরো দুইজন বিপ্লবী ছিলেন, যথাক্রমে, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (জন্ম, ১৮৮০, হায়দরাবাদ), অবনী মুখার্জি (জন্ম, ১৮৯১, জাব্বালপুর, ভারত)। স্ট্যালিনের আমলে তাদের তিনজনকেই ১৯৩৬-১৯৩৭ সালের মধ্যে প্রথমে গুপ্তচরবৃত্তির মিথ্যা সন্দেহে গ্রেফতার ও পরে সামরিক আদালতের রায়ে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোট বোন ছিলেন সরোজিনী নাইডু। যিনি মহাত্মা গান্ধীর বিশেষ ও ঘনিষ্ঠ ও সহযোগী ছিলেন। অন্যদিকে বলতে গেলে মহাত্মা গান্ধী ছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একদম বিপরীত, গান্ধী ব্রিটিশ হোম গর্ভমেন্টের কাছে আবেদন করে দাবীদাওয়া আদায়ের পক্ষে এতটাই প্রবল ছিলেন যে তার কারণে ভারতে কোনো শক্তিশালী বিপ্লবী রাজনীতিই দাঁড়াতে পারেনি। এমনকি কংগ্রেসকে বিপথে চালিত করায়ও তার অবদান সবচেয়ে বেশি। তবে ভারতে সমাজতন্ত্র কখনও থামেনি। সে অন্যকথা, এখানে বাংলাদেশের বিপ্লবী লুহানীকে নিয়ে মতিউর রহমানের গোলাম আম্বিয়া খান ‍লুহানী এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি পড়া যেতে পারে। বইটিতে বাংলাদেশের এই বিপ্লবীকে দীর্ঘগবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্তে তুলে আনা হয়েছে। বইটি নানাকারণেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই যে কার্ল মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেলিন মনে করতেন পৃথিবীজুড়ে সমাজতন্ত্র দরকার। তারই জন্য ব্রিটিশ ভারত থেকে অসংখ্য তরুণ তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া গিয়েছিলেন। তাদেরই একজন ছিলেন বাংলাদেশের লুহানী। তিনি মনে করতে গান্ধীবাদী রীতিতে স্বাধীনতা স্বাধীনতা নয়। আমরা পরে দেখতে পেয়েছি, ভারত কখনওই সবলে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি, তাদেরকে স্বাধীনতা দিয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এই কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে একমাত্র দেশ প্রকৃতঅর্থে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, সেটি বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে। কারণ বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা ছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ধনিকতন্ত্র বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে কখনও স্বাধীনভাবে ক্রিয়া করতে দেয়নি।

সাম্যবাদ বা কম্যুনিজম বলতে আমরা যা বুঝি সেটা যদি এভাবে দেখা যায়, কোনো কোম্পানীর মুনাফা সবার ভাগেই সমানভাগে পড়ছে তাহলে সেখানে কোনো ধনীক শ্রেণী তৈরি হতে পারে কী? পারবে না কারণ তখন সকলেই মালিক। একদিন এরকমই ঘটবে বলে ধারণা মার্ক্সের। একদিন শ্রমিকরা ক্ষমতাযন্ত্রের দখল নিয়ে নিজেদের আধিপত্য তৈরি করবে। তখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে কিছু থাকবে না, সম্পতি সবই হবে রাষ্ট্রের। এবং কোনো শ্রেণীই থাকবে না। সাম্যের মূল কথাটাই এই যে সেটা হবে শ্রেণীহীন। এরকম শ্রেণীহীন সমাজের উদাহরণ আমরা দেখতে পাই সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯১৭ সালে, লেলিনের নেতৃত্বে হওয়া বলশেভিক বিপ্লব বা অক্টোবর বিপ্লবে। মাও সে-তুং-এর ১৯৪৯ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আমরা দেখেছি। কিন্তু শ্রেণীহীন সাম্যের সমাজের স্বপ্ন মরেনি। বিশ্বজুড়েই বিপ্লবীরা নিজেদের ভুল শুধরে অগ্রসর হওয়ার পথে এগুচ্ছে। ভারতে চলছে মাওবাদীদের উপর অকথ্য অত্যাচার। বুকারজয়ী কথাসাহিত্যিক অরুন্ধতী রায় বিশ্বের সামনে এনেছিলেন সে কথা। বিপ্লবের স্বপ্ন মরেনি এটাই দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে কখনওই উগ্রপন্থা জয়লাভ করতে পারেনি, ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানেও সমাজতন্ত্রের অবদান কম নয়। ছাত্রদের, জনমানুষের, মধ্যবিত্তের পথে নেমে আসা, সুসংগঠিত প্রতিরোধ এসব সমাজতন্ত্রের সাথে খুবই যায়, জুলাইয়ে বামপন্থী, ডানপন্থী সবাই তখন সাম্যই চেয়েছিল। আলতাফ পারভেজের লালজুলাই চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমা বইটির জুলাইয়ের ধারাবাহিক বিবরণটি দেখলেই বোঝা যাবে। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানও ইতোমধ্যেই ধনিকতন্ত্র দখল করেছে এরকমই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তবে সাম্য যদি সমাজতন্ত্রের আদর্শ হয়, বাংলাদেশ একদিন সেই সাম্য পাবে। তা যে রূপেই আসুক না কেন।

বর্তমানে পুঁজির বিশ্বায়ন ঘটেছে প্রবলভাবে। পণ্যের বাইরে কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না। আর এর থেকে উত্তরণের জন্য মার্ক্সের দেখানো পথের বিকল্পও আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। তাই কার্ল মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো, লেলিন, আন্তনিও গ্রামসি এখনও এতো প্রাসঙ্গিক যে, বারেবারেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব বিপ্লবী জনসাধারণের তার, তাদের কাছে ফিরতে হয়। সমাজতন্ত্র শুধু কতিপয় কমিটির উপর নির্ভর নয়, কার্ল মার্ক্সের ডাস সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও ইতিহাসের বিজ্ঞানভিত্তিক অন্বেষণের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই বাংলাদেশে প্রচলিত বামপন্থার দুরবস্থা থাকতে পারে, কিন্তু সেটি কার্ল মার্ক্সের কারণে নয় অবশ্যই। শোষিত জনগণই বাংলাদেশে প্রচলিত সমাজতন্ত্রের দোষ-ত্রুটি কাটিয়ে সর্বহারাদের ক্ষমতা কায়েম করবে একদিন এই আশা জারি রাখা যায়।

 


মন্তব্য করুন