তিনি কবিতা বা কথাসাহিত্য যাই লেখেন সেখানে একটি কেন্দ্রবিন্দু তো থাকেই সেইসাথে একটি রহস্যও থাকে যা তার লেখাকে কেন্দ্র ছাড়িয়ে যেতে সাহায্য করে। বিশেষ করে তার কথাসাহিত্যে এই গুণটি কবিতা থেকেই এসেছে। রায়হান রাইনের একটি বিষণ্ন রাইফেল উপন্যাসেও এই বৈশিষ্ট্যটি আছে।
ফলে, উপন্যাসটি যেকোনো সময়ের হয়ে ওঠে। আদতে রাষ্ট্র তো এরকমই, সে তার মতের বাইরে কাউকে সহ্য করে না। সব রাষ্ট্রব্যবস্থাতেই শাফায়েত কবিরের মতো মানুষ আছে যারা ভেঙে যেতে চায় না, রুখে দাঁড়ায় যতটুকু সামর্থ আছে তা নিয়ে।
উপন্যাসের মূল আখ্যানভাগ এরকম, শাফায়েত কবির নামের একজন লোককে কে বা কারা অপহরণ করে, এরপর ক্রমাগত হুমকি আসতে থাকে তার কাছে। সেইসূত্রে তার মায়ের প্রেমিক, যিনি মুক্তিযোদ্ধা, তার অভিভাবক হয়ে ওঠেন। ঘটনাসূত্রে এসে দাঁড়ায় তার খালাত বোন, উপন্যাসে যার নাম নুসরাত। রাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়ে একসময় আত্মগোপনে চলে যেতে হয় শাফায়েতকে। সে ভাবে তার অভিভাবক, খালাত বোন—তারাও রাষ্ট্রের কূটকৌশলে জড়িত কীনা। সন্দেহ তাকে ঘিরে রাখে। তনুজা শারমিন নাকে একজন আর্টিস্টের চিত্রপ্রদর্শনীতে সে নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পায়, সে হয়ে ওঠে মুনশি ইব্রাহিম। এসব আপাত পরস্পরবিরোধী ঘটনার সমাবেশে আখ্যানটি একটি শ্বাসরুদ্ধকর থ্রিলারে রূপ নেয় যেন।
এই হলো উপন্যাসের মূলকেন্দ্র, এখানে আমরা খুব সহজেই বিগত সরকারের ছায়া দেখতে পাই। এই রাষ্ট্রীয় অপহরণ, গুম, হত্যা—তখন এর সবই সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশে। সেইসব গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের মধ্যেই শাফায়েত একজন, যে কীনা নিজেকে আত্মগোপনে গিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তবে, কী হতো যদি সে নতি স্বীকার করতো? আমরা দেখতে পাই সে তার দায়িত্বে খুবই সৎ, তাই সে নতি স্বীকার করবে না কোনোভাবেই। ফলে, তাকে চুপ করিয়ে দেওয়ার সর্বোত্তম পন্থাটাই রাষ্ট্র বেছে নিয়েছে। তবে, সে বেঁচে যায়, আর উপন্যাসের শেষে আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের আভাস পাই। এটি আমাদের আশাবাদী করে তোলে।
রায়হান রাইনের একটি বিষণ্ন রাইফেল উপন্যাসের বিশেষত্ব হলো লেখক এখানে আমাদের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিকে বেছে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার গল্পবিন্যাসে সেটিকে সাম্প্রতিকতা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। ফলে, উপন্যাসটি যেকোনো সময়ের হয়ে ওঠেছে। এই সমকালকে চিরকালের সঙ্গে মেলানোর আঙ্গিকের দেখা আমরা পেয়েছিলাম রায়হান রাইনের কথাপুষ্প: প্রজ্ঞাবানদের বলা গল্প নামে অনুবাদ বইয়েও। বইটিতে তিনি অনুবাদের জন্য বাছাই করেছিলেন সেইসব প্রাজ্ঞ গল্প যা আমাদের সময়ের কথাও বলে। পৃথিবীর সব ক্লাসিক সাহিত্যেরই এই গুণ, যে তারা সবসময় সমকালকে ধারণ করে চিরকালীন হয়ে। রায়হান রাইনের স্পর্শযোগ্য ভাষায় লেখা একটি বিষণ্ন রাইফেলও সেরকম।
আদতে রায়হান রাইনের একটি বিষণ্ন রাইফেল উপন্যাসের রাষ্ট্র তো চিরকালীনই, সে তার মতের বাইরে কাউকে সহ্য করে না। কিন্তু আশার কথা হলো সব রাষ্ট্রব্যবস্থাতেই শাফায়েত কবিরের মতো মানুষ আছে যারা ভেঙে যেতে চায় না, রুখে দাঁড়ায় যতটুকু সামর্থ আছে তা নিয়ে। তারাই আমাদের স্বপ্ন দেখায়, অনুপ্রেরণা দেয়। তাদের কারণেই একদিন মানুষের অবদমনের অবসান হয়ে তারা ভাষা খুঁজে পায়, আর সমস্বরে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। উপন্যাসটিতে সেই প্রতিতীই জাগিয়েছেন রায়হান রাইন।
একটি বিষণ্ন রাইফেল
লেখক : রায়হান রাইন
বিষয় : উপন্যাস
প্রকাশকাল : ২০২৫
প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন
দাম : ৫৫০ টাকা।
