দিপু চন্দ্র দেব
ফ্রেডরিখ জেমিসন তার “দ্য মডার্নিস্ট পেপারস” বইয়ের এক প্রবন্ধে জেমস জয়েসের “ইউলিসিস” (1922) নিয়ে বলেছিলেন, জয়েসের আধুনিকদের সূত্র নিজের মতো ব্যবহার করায় ইউলিসিস হয়ে উঠেছে উত্তরাধুনিক উপন্যাস। জয়েস লিওপোল্ড ব্লুম-এর পরিচয় দিয়েছিলেন “দ্য গ্রেট টকার” বলে। জেমিসনের মূল সূত্রটি এখানেই, কারণ ব্লুম ডাবলিনে প্রতিবারই পরিচিত কাউকে না কাউকে পেয়ে যায়, তাদের কথা হয়, আড্ডা চলে। কিন্তু আধুনিক উপন্যাসে এরকম সম্ভব নয়, কারণ সেখানে মেট্রপলিস বা মহানগর যেগুলো ঔপনিবেশিক প্রভুদের তৈরি, সেখানে ঘর থেকে বের হয়ে পরিচিত কাউকে পাওয়া যায় না। কিন্তু ডাবলিনে কীভাবে পাওয়া যায়? এর কারণ ডাবলিন উপনিবেশিত শহর। সে বড় কিন্তু লন্ডনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিহীনতা তার নেই, তার মধ্যে থাকা কফি হাউস, পাব—সবখানেই সবারই কোনো না কোনোভাবে পরিচিত কাউকে পেয়ে যাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের আধুনিক উপন্যাস বলে যেগুলো পরিচিত সেগুলোকে জেমিসনের উত্তরাধুনিক মানদণ্ডে পর্যালোচনা করে দেখা উচিত। উত্তরাধুনিকতা বলে যে সাহিত্যকে আমরা বিচার করি, তার কতখানি উত্তরাধুনিক আর কতখানি আধুনিক তদন্ত করা সহজ হবে এতে। নতুন কোনো দুয়ারও খুলে যেতে পারে কে জানে। ঝুম্পা লাহিড়ি’র উপন্যাস “হদিস” যেটি তিনি মূলে ইতালিয়ান ভাষায় লিখেছেন, পড়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। তার বিষয়বস্তুর সাহিত্যরূপ ধরার জন্য, উপরের আলোচনা। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন তানভীর ইসলাম। তার মূলানুগ অনুবাদ বইটিকে বাংলা ভাষার উপযোগী করে তুলেছে।
ঝুম্পা লাহিড়ি অভিবাসী সাহিত্যিকদের একজন। আর “হদিস” উপন্যাসটি আধুনিক এবং উত্তরাধুনিক সাহিত্য ধারার মাঝামাঝিতে অবস্থান করছে, বা এতে দুইয়ের মিশ্রণ ঘটেছে বলাই শ্রেয়। প্রথমত, এই নিঃসঙ্গ অধ্যাপিকার কোনো তথ্যই জানা যায় না, আর যা জানা যায় সেগুলো আমাদের কোনো নিশ্চয়তা দেয় না। এই পরিষ্কারভাবে জানার কারণে এখানে আধুনিকদের শেকড়হীনতা ও বিশ্বাসহীনতার বিষয়টি ভালোভাবে খাপ খেয়ে যায়। আবার আধুনিক সাহিত্য যে বহুঅর্থবোধক সেটিও পাওয়া যায়। অন্যদিকে আবার তার কিছু বন্ধু-বান্ধব আছে, যাদের সাথে তার দেখা হয়, আড্ডা হয়। সেটি জয়েসের “ইউলিসিস”-এর মতো উত্তরাধুনিক হয়ে উঠার দিকে ইঙ্গিত করে।
লাহিড়ি’র সাহিত্যে অভিবাসীদের জীবন অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকে। কারণ তিনি অভিবাসী। তিনি ইংরেজিতে লিখলেও, ইতালিতে স্থায়ী হওয়ার পরে ইতিলিয়ান ভাষায় লেখা শুরু করেছেন। মাতৃভাষা ছাড়া সৃষ্টিশীল সাহিত্য সম্ভব নয়, এই ধারণাকে লাহিড়ি যেন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন।
উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে চল্লিশোর্ধ এক অধ্যাপিকার প্রতিদিনকার নিঃসঙ্গ জীবন নিয়ে। বর্ণনাকারীর কোনো নাম নেই। উপন্যাসের স্থানও নামহীন। এবং অধ্যাপিকার জীবনের কোনো পরিষ্কার তথ্য নেই। তার কোনো পরিবার নেই, স্বামী-সন্তান নেই। শুধু কিছু বন্ধুবান্ধব আছে। গল্পের কোনো প্লট নেই। তিনি প্রতিদিন যা যা করেন তারই একটি বৃত্তান্ত পুরো বইটি। ছেচল্লিশটি অধ্যায়ের কোনোটির নাম, “শহর” কোনোটি “প্রতিবেশি”। ফলে তিনি কোথায় বাস করেন সেটা জানা যায় না, তার বাসস্থানও নামহীন।
এখানে একটি বিষয় এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, সেটি হলো একসময় ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ তৃতীয় বিশ্বের কন্ঠস্বরকে না শোনার যতরকম ব্যবস্থা তার সবই করেছিল। জেমিসনের মতে সময়টি ছিল উপনিবেশের প্রথমদিককার, কিন্তু একসময় সেটি আর কাজ করছিল না। পরে সব বাধা খুলে দেওয়া হয়, আর তাই লাতিন আমেরিকার বুম জেনারেশন বা জাদুবাস্তবতা (গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ যার উজ্জ্বল প্রতিনিধিদের একজন), আফ্রিকার সাহিত্যিকবর্গ (চিনুয়া আচেবে, নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো), অভিবাসী সাহিত্যিকদে নতুন কন্ঠস্বর—বিচিত্র সব সাহিত্য ঘরানা প্রথম বিশ্বে প্রবেশ করে, আর পরবর্তীতে এর ফলও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।
ঝুম্পা লাহিড়ি অভিবাসী সাহিত্যিকদের একজন। আর “হদিস” উপন্যাসটি আধুনিক এবং উত্তরাধুনিক সাহিত্য ধারার মাঝামাঝিতে অবস্থান করছে, বা এতে দুইয়ের মিশ্রণ ঘটেছে বলাই শ্রেয়। প্রথমত, এই নিঃসঙ্গ অধ্যাপিকার কোনো তথ্যই জানা যায় না, আর যা জানা যায় সেগুলো আমাদের কোনো নিশ্চয়তা দেয় না। এই পরিষ্কারভাবে না জানার কারণে এখানে আধুনিকদের শেকড়হীনতা ও বিশ্বাসহীনতার বিষয়টি ভালোভাবে খাপ খেয়ে যায়। আবার আধুনিক সাহিত্য যে বহুঅর্থবোধক, সেটিও পাওয়া যায়। অন্যদিকে আবার তার কিছু বন্ধু-বান্ধব আছে, যাদের সাথে তার দেখা হয়, আড্ডা হয়। সেটি জয়েসের “ইউলিসিস”-এর মতো উত্তরাধুনিক হয়ে ওঠার দিকে ইঙ্গিত করে। প্রথম বিশ্বের একটি মহানগরে (সম্ভবত, কারণ অধ্যাপিকা কোথায় থাকেন সেটির নাম নেই) ভারতীয় এক লেখিকা বলছেন এক শেকড়হীন অধ্যাপিকার কথা, কিন্তু তার আবার বন্ধুবান্ধবও আছে। ফলে, তাকে শেকড়ীন বলা বাস্তবসম্মত নয়, কিন্তু তার নিজের ও চারিপার্শ্বের সবকিছুর নামহীনতা তারই ইঙ্গিত দেয়।
উপন্যাসটিকে তাই আধুনিক, উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে সবকিছুর মিশ্রণ হিসেবে পড়া ভালো। কেননা একজন অভিবাসীর কাছে পুরো পৃথিবীই তার কিন্তু যা তার সেটিকে সে ছেড়ে এসেছে। ফলে, লাঁকা কথিত আমি’র শূন্যতা তার সাহিত্যে পাওয়া যাওয়ার কথা। ঝুম্পা লাহিড়ি’র ইতালিতে ডোভ মি ত্রবো, ইংরেজিতে হ্যোয়ারএবাউটস তাই ব্যক্তি আমি যখন ভাষার আমিতে প্রবেশ করে, তার অভিবাসন ঘটে, আর এরপর যে চিরজীবনের জন্য শূন্যতার দখলে চলে চায়—তারই উপাখ্যান।
হদিস
লেখক: ঝুম্পা লাহিড়ি
অনুবাদ: তানভীর ইসলাম
বিষয়: অনুবাদ উপন্যাস
প্রকাশকাল: ২০২৫
প্রকাশক : জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
দাম : ৩২০ টাকা।
বইটি কিনতে চাইলে: