বাহিরানা

ইচক দুয়েন্দের লালঘর: থানা-জেলের রূপকে সামাজ-রাষ্ট্র


শামসুল কবীর ইচক দুয়েন্দে নামে কবিতা ও গল্প লেখেন। তিনি বাংলাদেশের ৭০ দশক পরবর্তী সাহিত্যের পালাবদলে অগ্রগণ্যদের একজন, বিশেষ করে সাহিত্যের নতুন কাঠামো নির্মাণের ভূমিকায় থেকে। শাহবাগের আজিজের আড্ডায় একসময় তার আনাগোনা আজ মিথের পর্যায়ে। সম্পাদক, প্রকাশক, কবি, কথাসাহিত্যিক—বিচিত্র পরিচয়ে তিনি পরিচিত, বর্তমানে নিভৃতে রাজশাহী শহরে বসবাস করছেন। লেখার জগতে তার বিশেষত্ব হলো তিনি ভিন্নভাবে দেখেন সবকিছু, সমাজ-রাষ্ট্র-মানুষ-সংঘ সব বিষয়কেই তিনি আলাদাভাবে চিহ্নিত করেন, কী কবিতায় কী গল্প-উপন্যাসে, সেটি এমনকি তার জীবনাচরণেও দৃষ্ট হয়।

ইচক দুয়েন্দের লালঘর উপন্যাসটি সেরকমই, আধুনিক মানুষেরা সমাজ ও রাষ্ট্রকে ‍সুস্থ রাখতে গিয়ে আদতে তাদেরকে থানা-হাজতে রূপান্তরিত করে ফেলেছে কীনা, কিংবা থানা-হাজত সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিজের মতো বানিয়ে ফেলেছে কীনা তারই উত্তর খুঁজেছেন তিনি উপন্যাসের চরিত্রদের মাধ্যমে। উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে তিনি বেছে নিয়েছেন রাষ্ট্রের সেইসব প্রতিনিধিত্বশীল অংশ থেকে রাষ্ট্রে যাদের থাকা অপরিহার্য।

উপন্যাসের গঠনের কথা বললে, প্রথাগত উপন্যাস কাঠামো থেকে এর নির্মাণ একদমই ভিন্ন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির পর্যন্ত বাংলাদেশের আধুনিক উপন্যাসের ধারা দেখলে আমরা দেখতে পাই সেখানে দর্শন আছে ঠিকই কিন্তু সেটি কাহিনির বুননের ভেতর সুপ্ত, খুব কৌশলে ঔপন্যাসিকের দর্শন সেখানে ফুঁটে ওঠে। কিন্তু ইচক দুয়েন্দের লালঘর উপন্যাসটি পুরোপুরি দর্শন নির্ভর, মানে এখানে তিনি আধুনিক উপন্যাসের যে ধারাটি বাংলাদেশে রয়েছে তার উল্টোপথে হেঁটেছেন, এখানে কাহিনি দর্শনের অনুবর্তী, পুরোগামী নয়। এর সঙ্গে দূরবর্তী সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায় আলব্যেয়ার কামুর দ্য আউটসাইডার উপন্যাসের।

উপন্যাসটি শুরু হয় এক লালঘর থেকে, সময়সীমা এক রাত। চিকচাক রুই দশজন সঙ্গীসহ লালঘরে বন্দী, সেসহ সেই ঘরে আরো দশজন মানুষ রয়েছে। চিকচাকের মতোই উদ্ভট, উদ্ভুত তাদের নাম, তার সঙ্গী কয়েকজনের নাম হলো, দিল আনচান ভাই, মিয়ান টিনটুই, ফ্লিজ ফ্যাল, পুঁই চুলভি। নামের এই উদ্ভটত্ব সত্ত্বেও তাদের প্রত্যেকেরই মিল হলো, তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তাদের অপরাধ হচ্ছে তারা রাস্তার পাশে মদ খেয়েছিল। পুলিশ সেটা ভালোভাবে নেয়নি, তাই তাদের ধরে এনেছে।

কিন্তু এর বিপরীত বিষয় দেখা যায়, যখন তাদের মতোই উদ্ভট নামের তাদের প্রভবশালী বড় ভাইয়েরা যখন লালঘরে তাদের সাথে দেখা করতে আসে তখন। তারা উপদেশের ফুলকি ছুটায় ও এখান থেকে তাদের বের করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এর মধ্যে লালঘরেই তাদের ব্যাগ থেকে মদের বোতল বের হতে দেখি আমরা, পুলিশের সামনেই। কিন্তু বড় ভাইদের কিছুই হয় না, আশ্চর্যজনকভাবে পুলিশও কিছুই বলে না। যেমন, এক বড় ভাই ‘হ্যাংলং ব্রিংলার’ তাদের বলে, “‘তুই ড্রিংক করতিস, এটা তো জানতাম না। একটু আধটু ইয়ে খাস, তা জানতাম। দিনে দুপুরে কী করতে ড্রিংক করছিলি? এই দ্যাখ আমার হাতে বোতল, বল্‌ এদেরকে ধরতে,’ হ্যাংলং ব্রিংলার তার হাতের মদের বোতলটি সান্ত্রির দিকে তাক করে বললেন মিয়ান টিনটুইকে।” (লালঘর, ইচক দুয়েন্দে)

কথা হলো, একই মদ, কিন্তু একপক্ষের শাস্তি হচ্ছে, অন্যপক্ষের হচ্ছে না। এখান থেকেই কী রাষ্ট্রকাঠামোর গলদটা বেরিয়ে আসে না? এই বিষয়টিই লেখক আমাদের দেখাতে চান। তিনি একরাতের ঘটনাগুলো দিয়ে আমাদের দেখান, রাষ্ট্রের সব বৈষম্য, ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা—এই ক্ষমতা তত্ত্বের কাছে এসেই জলের বুদ্‌বুদের মতো মিলিয়ে যায়। তাই রাতভর উদ্বেগের মধ্যেই—সমাজে সম্মান হারানোর ভয়, লালঘর থেকে কোর্টের রায়ে জেলে চালান হবার ভয়—উপন্যাসের চরিত্ররা লালঘরের প্রয়োজনীয়তা, এটি থাকা উচিত কী উচিত না—এসব বিষয় নিয়ে দার্শনিক আলাপচারিতা করে। মধ্যে মধ্যে তাদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতিচারণ করে চলচ্চিত্রের ফ্লাশব্যাকের মতো।

এরমধ্যে সাংবাদিকদেরও দেখা মেলে, তারা এখানে প্রকৃত ঘটনা নিয়ে নয় বরং ভয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ-এর জন্য এসেছে। তাদেরও বিশাল নেটওয়ার্ক। উপন্যাসের শেষে দেখতে পাই রাত্রিভর নানা উৎকন্ঠার শেষে মিয়ান টিনটুইদের যখন ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে তখন থানার সামনে অজস্র মানুষ, তাই তারা মুক্ত হয়েও স্বাভাবিকভাবে বেড়িয়ে যেতে পারে না। কারণ বাইরের মানুষেরা তাদের পরিচয় জেনে যেতে পারে, তাই তাদেরকে থানা কর্তৃপক্ষ থানার দেওয়াল টপকে বেরিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। তাদেরকে কয়েকটি দলে ভাগ করে দেওয়া হয়। এক পক্ষ বেরিয়ে যাওয়ার পর আসবে অন্য পক্ষের পালা, এখানেও উৎকন্ঠা, যে দল আগে বেড়িয়ে যাচ্ছে তাদের সাথে কী হচ্ছে, আর যে দল রয়ে যাচ্ছে আদতে তারা বেরুতে পারবে কীনা, এই নিয়ে। ফলে পুরো উপন্যাসটিই একটি দমবন্ধকরা উদ্বেগ-উৎকন্ঠার আখ্যান হয়ে ওঠে। এভাবেই উপন্যাসটি শেষ হয়।

ইচক দুয়েন্দে উপন্যাসটির মাধ্যমে একটি প্রশ্ন রেখেছেন, লালঘর বা হাজতঘরের আদতেই প্রয়োজন আছে কীনা। কেননা আমরা দেখতে পাই যাদের ক্ষমতা আছে তাদেরকে লালঘরমুখী হতে হয় না, যেমন উপন্যাসেরর হ্যাংলং ব্রিংলারদের। অন্যদিকে যাদের ক্ষমতা নেই তাদের সর্বস্ব খোয়াতে হয়, একবার লালঘরে ঢুকলে সমাজও তাদেরকে আর ভালোভাবে গ্রহণ করে না, ফলে তাদের লালঘরের বাইরের (সমাজ) আর ভেতরের জীবন—দুইই এক অশেষ লালঘর হয়ে ওঠে। থানা জেলখানা মানুষকে সামাজিকভাবেও কত নিপীড়ন ও হীন অবস্থায় পতিত করে তার জন্য বই থেকে চিকচাক রুইয়ের একটি বাক্য তুলে ধরছি,

“‘আমার বড়ভাই আর কোনোদিনও মায়ের কোলে ফিরে আসবে না। মৃতলোক থেকে আর কেউ ফিরে আসে না।

‘লজ্জা। লজ্জা। লজ্জা। ছি ছি ছি। আমরা বেরুব। ঢি ঢি রি রি পড়ে যাবে। কলঙ্ক। দুর্নাম। এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো ছিল।” (ঐ)

হাজত তাকে তার মৃত ভাইয়ের মতো মনে করাচ্ছে। মানে তাকে জীবিত মেরে ফেলা হয়েছে। তার কাছ থেকেই জেলহাজতের একটি ঐতিহাসিক কারণ জানতে পারি আমারা, দাস ব্যবস্থার ফল এই হাজত, তিনি বলেন,

“‘আইন ভঙ্গ করলেই প্রায় বিনা ব্যতিক্রমে মানুষের হাতে কেন পরাতে হবে হাতকড়া? কেন করতে হবে বন্দি?

‘এই নিয়ম তো চালু হয়েছিল ‘জোর যার মুল্লুক তার’ যখন চালু ছিল পৃথিবীতে তখন।” (ঐ)

মানে হচ্ছে বর্তমানে ক্ষমতাসীনরা মালিক ও রাষ্ট্রের বাকি সবাই হচ্ছে দাস। যাদেরকে যেকোনো সময় শাস্তি দেওয়া যায়। তাদের জীবনকে বিষিয়ে দেওয়া যায়।

তো বইয়ের মূল প্রশ্নের মধ্য দিয়ে আমাদের পর্যালোচনায় অ্যারিস্টটল থেকে মিশেল ফুকো—তাবৎ রাষ্ট্রতাত্ত্বিকদের কাজও চলে আসে। ফুকোর শৃঙ্খলা ও শাস্তি (Discipline and Punish) পড়লে বোঝা যেতে পারে, জেল, থানা এসবই রাষ্ট্রের শাসন প্রক্রিয়া বলবৎ রাখার চাবিকাঠি। রাষ্ট্রের হর্তাকর্তাদের যদি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে লালঘর তাদের লাগবেই। এর বিকল্প নেই—অন্তত এখন পর্যন্ত—যতক্ষণনা তারা অন্য কোনো ভয়ানক, আরো অসম্মানজনক কোনো দণ্ডদান পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারে। তাই ইচক দুয়েন্দে বা শামসুল কবীর আমাদের কোনো সমাধান দিতে পারেন না, আমাদের উপরেই পরিত্রাণের পথ খোঁজার ভার চাপিয়ে দেন। একটি সার্থক সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যই এই—পাঠকদের তার সঙ্গে যুক্ত করা। তাই উপন্যাসটি শেষ হয়েও পাঠকদের মনে নতুন করে লেখা হতে থাকে। লালঘর প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৯ সালে, বর্তমান পৃথিবীতে অনেককিছুর বদল ঘটেছে, যুক্ত হয়েছে অনেকিছু। কিন্তু একটি জিনিস অবিকল একইরকম থেকে গেছে, সে হলো দণ্ডদানের প্রক্রিয়া। এখনও ক্ষমতার কাছে থানা ও জেলই দণ্ডের প্রধান হাতিয়ার বা প্রথম পছন্দ।

উপন্যাসটি নিজেতে নিজে নতুন। বাংলা ভাষা বা কথাসাহিত্য শুধুমাত্র একটি বা দুটি কেন্দ্রীয় চিন্তাকেও যে উপন্যাসরূপ দিতে পারে লালঘর উপন্যাসটি তার প্রমাণ। তাই উপন্যাসটি শুধু নতুনই নয় পথপ্রদর্শকও। চিন্তাকে নতুনভাবে ফুঁটিয়ে তোলার আঙ্গিক ব্যবহারের কারণে উপন্যাসটির ভাষাও হয়েছে উঠেছে জড়তাহীন, নতুন ও সতেজ। কাহিনির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এড়িযে শুধুমাত্র চিন্তার উপর, তত্ত্ব ও দর্শনের উপর ভবিষ্যতে প্রতিভাবান লেখকদের নুতন কথাসাহিত্য রচনার পথ দেখানোর ভিত্তি স্থাপন করেছে ইচক দুয়েন্দের লালঘর উপন্যাসটি।

লালঘর
লেখক: ইচক দুয়েন্দে
বিষয়: উপন্যাস
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০০৯
মূল্য: ১২৫ টাকা।

ইচক দুয়েন্দে নামের আড়ালে থাকা কবি ও কথাসাহিত্যিক শামসুল কবীর-এর ঘনিষ্ঠজনদের অন্যতম কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ বাহিরানা Talk-এ তার নাম উল্লেখ করেছেন।


মন্তব্য করুন