জয় সেন
(সর্বশেষ আপডেট ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫)
“বাড়িটা যখন খুঁজে পেলাম, দিনের আলো তখন ফুরিয়ে এসেছে। গলির বাহান্ন পাক, নর্দমা, নারকেলের পচা খোসা, ধুলোর ঠাসা অসহ্য পতন সব ছাপিয়ে এতোক্ষণ একটা উদ্দীপনাই কাজ করছিল—যেভাবেই হোক বাড়িটা খুঁজে বার করা।” নাসরীন জাহানের উড়ুক্কু উপন্যাসটি এভাবেই শুরু হয়। কে এই কথক তার নাম জানতে পারি না প্রথমে। টানা মেদহীন বাক্যের এই সূচনা, পরবর্তীতে কী ঘটবে তার কিছুরই ইঙ্গিত দেয় না। তবু, এরকম নিরাবরণ বর্ণনার রসপূর্ণ সূচনাবাক্য নিয়ে বাংলা সাহিত্যে কম উপন্যাসই শুরু হয়েছে এরকমও বলা যায় না। কিন্তু বাক্যগুলোতে যে অভিঘাত বদ্ধ করেছেন, এবং যার রেশ ও প্রক্রিয়া পুরো উপন্যাসজুড়েই জুড়েছেন নাসরীন জাহান সেরকম শক্তিশালী গদ্য আঙ্গিক বাংলা কথাসাহিত্যে কমই। এই বইটি তাই এই লেখিকাকে বাংলাসাহিত্যের প্রথম শ্রেণীর লেখকদের কাতারে নিয়ে গেছে। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। এর পরের বছর ১৯৯৪ সালেই এর জন্য ফিলিপস পুরস্কার পান।
সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ বা পড়তে পড়তে একজায়গায থমকে যেয়ে মুখ থেকে আলগোছে নিজের অজান্তে বেরিয়ে আসে মারভেলাস! শব্দটি। যখন ওমর ও ইরফান চাচা (নীনার মায়ের এককালের প্রেমিক)—এই দুই চরিত্রকে আবিষ্কার করি নতুন করে। এরমধ্যে ওমর চরিত্রটির প্রথম আবিষ্কার বিস্ময় জাগায়, আর ইরফান চরিত্রটির মধ্যে আছে সৌম্যকান্তি আভিজাত্য। উপন্যাসে তাদের ভূমিকা নীনার জীবনজুড়ে হলেও, নাসরীন জাহান চরিত্রদুটিকে নির্মাণনৈপুন্যে স্বতন্ত্র করে তুলেছেন। চরিত্র দুটির প্রসঙ্গে উড়ুক্কু’র আঙ্গিকের জট না খুলেই বলা যায়—নাসরীন জাহান শুধু বাংলাদেশের একজন প্রথম শ্রেণীর কথাসাহিত্যিকই নন, তিনি একজন প্রথম শ্রেণীর কবিও। তিনি গঠনের সম্পূর্ণতা নিয়ে এতই বিষ্মিত করেন যে তা চিরকালীন দাগ রেখে যায়।
উপন্যাসটি মধ্যবিত্তশ্রেণীর নারী নীনাকে নিয়ে। উপন্যাসের নামের সাথে তার জীবনের খুব মিল, সে উড়ন্ত, ভাসমানও বলা যায়। তার ব্যর্থ সংসার, স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ, জন্ডিসে সন্তানের মৃত্যু, ঢাকায় সাবলেট হিসেবে বাস করা। ওমর নামে একজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পরা এবং তার সন্তান ধারণ করে সেই পেটের সন্তান রাখবে কী রাখবে না এরকম দ্বিধা। মায়ের এককালের প্রেমিকের কাছে ভরসা খোঁজা। জীবনের সম্ভাব্য ও অসম্ভাব্য সব বাঁক ও বিস্তৃতি ধারণ করে নীনার জীবন। জীবনের সম্ভাব্য ও অসম্ভাব্য বলার কারণ নাসরীন জাহান এই চরিত্রটিকে মহাজীবনের সমুদ্রে উড্ডয়ন করিয়েছেন। তাই চরিত্রটি সাধারণের মধ্যে অসাধারণ হয়ে ওঠেছে।
উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় একটি থিম হচ্ছে দ্বিধা, সংশয় ও উদ্বেগ। জ্যাঁ পল সার্ত্রের রোডস টু ফ্রিডম উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ম্যাথিউ দ্যেলারু’র মধ্যে পরিচারিকা বা প্রেমিকার গর্ভে তার বাচ্চা আসার পর যে উদ্বেগের দেখা পাওয়া যায়। যে সর্বগ্রাসী উদ্বেগ তাকে তাড়িত করে সেরকম উদ্বেগ নীনার অস্তিত্বজুড়ে। বাংলাদেশের সব নারীদের মধ্যেই এই উদ্বেগের অস্তিত্ব রয়েছে। বিশেষ করে যারা স্বাধীনভাবে জীবন চালনা করতে চায়। নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে চায়। উমরের সঙ্গে সম্পর্কের ফলে গর্ভে সন্তান চলে আসার পর, এই সন্তান নিয়ে সমাজ কী ভাববে, সন্তানকে কি পরচয়ে বড় করবে, মোটকথা তাকে পৃথিবীর আলো দেখতে দেওয়া উচিত নাকি উচিত না তা তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু সূচনা বাক্যগুলোতেই এই উদ্বেগ ও দ্বীধা যে তার অস্তিত্বেরই অনিবার্য অংশ সেটি নাসরীন জাহান আমাদের জানিয়ে দেন। বাবার উচ্চবিত্ত মামাত ভাইয়ের বাড়ি খুঁজতে গিয়ে সে সন্ধার বৃষ্টিতে অপরিচিত এক গলিতে আটকা পড়ে, “সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, বারান্দায় ভিখিরি দুটো নেই। যে ঝুলমুলে, আঠালো আর দুর্গন্ধ-ছড়ানো কাঁথা তাদের গায়ে লেপটে ছিল, তারা চলে গেলেও, তার কিছু টুকরো-টাকরা আর উৎকট গন্ধটা তো থাকবার কথা। আমি সীমাহীন ধুম্রজাল ভেদ করে দেখি, তারা নেই, তাদের চিহ্নটুকু পর্যন্ত নেই। বৃষ্টির মধ্যে কখন বেরিয়ে গিয়েছে, খেয়ালও করিনি। এখন সরু বারান্দার পুরোটা জুড়ে আমি আর সেই লোকটা।”
উড়ুক্কু কিনতে চাইলে
এই উদ্বেগে ভয় থাকলেও সে পরে লোকটির মুখোমুখি হয়। তার কাছে বাবার খালাত ভাইয়ের বাসার ঠিকানা জানতে চায় সংক্ষিপ্তভাবে। এই জায়গাটাতেই নাসরীন জাহান একটি শক্তিশালী চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। নীনা চরিত্রটি ভেঙে যেতে যেতেও উঠে দাঁড়ায় আবার। স্বামী রেজাউলের সঙ্গে সংসার ভেঙে গেলেও তার জীবন শেষ হয়ে যায় না। কোথাও না কোথাও জীবনরস খুঁজে পেয়ে ফের ঘুরে দাঁড়ায়। যেমন রেজাউলের সঙ্গে থাকাকালীন সময়ে তারা যে অন্য একটি পরিবারের সঙ্গে সাবলেট থাকত তখন সাবালেট বাসার অন্যদের অত্যাচারে যখন জীবন অতিষ্ঠ তখন তার রেজাউলের বন্ধু সত্যজিৎ-এর সঙ্গে পরিচয় হয়। আড্ডাবাজ সহজস্বভাবের ছেলেটি তার যন্ত্রনা কমাতে সাহায্য করে। উড়ুক্কু উপন্যাসের অনেক অনেক চরিত্রের ভিড় দেখতে পাওয়া যায়, নীনার জীবনকে ঘিরে তাদের আগমন।
এরমধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ বা পড়তে পড়তে একজায়গায থমকে যেয়ে মুখ থেকে আলগোছে নিজের অজান্তে বেরিয়ে আসে মারভেলাস! শব্দটি। যখন ওমর ও ইরফান চাচা (নীনার মায়ের এককালের প্রেমিক)—এই দুই চরিত্রকে আবিষ্কার করি নতুন করে। এরমধ্যে ওমর চরিত্রটির প্রথম আবিষ্কার বিস্ময় জাগায়, আর ইরফান চরিত্রটির মধ্যে আছে সৌম্যকান্তি আভিজাত্য। উপন্যাসে তাদের ভূমিকা নীনার জীবনজুড়ে হলেও, নাসরীন জাহান চরিত্রদুটিকে নির্মাণনৈপুন্যে স্বতন্ত্র করে তুলেছেন। চরিত্র দুটির প্রসঙ্গে উড়ুক্কু’র আঙ্গিকের জট না খুলেই বলা যায়—নাসরীন জাহান শুধু বাংলাদেশের একজন প্রথম শ্রেণীর কথাসাহিত্যিকই নন, তিনি একজন প্রথম শ্রেণীর কবিও। তিনি গঠনের সম্পূর্ণতা নিয়ে এতই বিষ্মিত করেন যে তা চিরকালীন দাগ রেখে যায়।
আরেকটি বিষয় এই বইয়ের মধ্যে থাকা অজস্র উপমা, উপন্যাসটিকে অন্যমাত্রা দিয়েছে। কবিতাগুণ যুক্ত হয়েছে এর ফলে। যেমন, “বৃষ্টি ঝরছে পুরো পরিবেশটাকে বিধবা, সাদা করে দিয়ে” হাসপাতালে গন্ধকে নীল বিষের সাথে তুলনা, “আশ্চর্য নীল বিষের ভাণ্ড ডাক্তার তুলে দেন আমার হাতে, পান করো”। এরকম অজস্র উপমা রয়েছে বইটিতে। এরসঙ্গে মেদহীন গদ্য যেটা প্রথমে বলেছিলাম তার সঙ্গে কবিতার রস মিশ্রিত হয়ে এক অসম্ভব কথাসাহিত্য হয়েছে নাসরীন জাহানের উড়ুক্কু উপন্যাসটি।
নাসরীন জাহান তার দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যেগুলো আছে, উপন্যাস: চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার(১৯৯৫), লি(১৯৯৭) শঙ্খনর্তকী(২০০৩), গল্প: সারারাত বিড়ালের শব্দ(১৯৮৯), এলেনপোর বিড়াল। এগুলো ছাড়াও তার প্রায় প্রত্যেকটি কাজই স্বতন্ত্র, তবে উড়ুক্কু ও এলেনপোর বিড়াল বই দুটিতে তিনি কথাসাহিত্যের শিল্পের শিখর স্পর্শ করেছেন। এরমধ্যে উড়ুক্কু আবার তার প্রথম উপন্যাস, ফলে এর একটা আলাদা গুরুত্ব আছে বৈকি।
উড়ুক্কু
লেখক: নাসরীন জাহান
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৩
বাতিঘর সংস্করণ: ২০২৩
মূল্য: ৭০০ টাকা।
বইটি কিনতে চাইলে: