বাহিরানা

অথৈ (২০২৪) চলচ্চিত্র রিভিউ—অনির্বাণের ওথেলো, এক্সপেরিমেন্টাল, কিন্তু সফল কি!


মামুনুর রশিদ তানিম

“সবটাই অবিশ্বাস। ঘৃণাই পরম সত্য!” সিনেমাজুড়ে এই সত্যই প্রতিষ্ঠা করতে চায় ‘অথৈ,’ আজকের পৃথিবীর নিরীখে, যেখানে দলিতের-শোষিতের মৃত্যু স্বাভাবিক; অপুষ্টি স্বাভাবিক; যু’দ্ধ স্বাভাবিক; ঘৃণা স্বাভাবিক। শেক্সপীয়রের ‘ওথেলো’কে পুঁজিবাদ, শ্রেণীসংঘাত, বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলার আধুনিক মোড়কে বেঁধেছে ‘অথৈ’; অহম, ভালোবাসা, কামুকতা, সন্দেহ ও ঘৃণা তথা মূল বিষয়াদিগুলোকে অনড় রেখে। তবে ‘অথৈ’ যে খুব ভালো হয়েছে তা না। আসলে ‘অথৈ’- এর ব্যাপারে সরাসরি ভালো বা মন্দ বলার চাইতে মিশ্র বলাটা যৌক্তিক হবে। এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা যেহেতু।

তবে বয়ানে এবং বক্তব্যেই শুধু এক্সপেরিমেন্টাল হয়নি, ভিজ্যুয়ালিও বেশ এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা ‘অথৈ’। এমন স্বকীয়, চোখ ধাঁধানো ভিজ্যুয়াল সচরাচর বাংলা সিনেমায় দেখা যায় না। (প্রযোজনায় জিও স্টুডিওস যুক্ত থাকায়, এই বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকতে পারে হয়ত।) সিনেম্যাটিক তো বটেই, তারচেয়েও বড় কথা এই অ্যাস্থেটিক্যাল চয়েজ ন্যারেটিভের অর্থ মেনে তাতে গভীরতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং সফলও হয়েছে। শুধু চোখে ধাঁ লাগানোর জন্যই এমন ভিজ্যুয়াল নয়, বরঞ্চ আবহের সাথে মিলিয়ে এর লাইটিং, কালার করা হয়েছে

অনির্বাণের শেক্সপীয়র ট্রিলজির মাঝে সবচেয়ে এক্সপেরিমেন্টাল, যদি সিনেমা হিসেবে এর বাণিজ্যিক আবেদনের দিকটা চিন্তায় আনা হয়। ‘তালমার রোমিও জুলিয়েট’ (সিরিজ) তো কিছুই হলো না। আসলে, ‘মন্দার’ বাদে বাকি দুটোই, ‘অথৈ’ এবং ‘তালমার রোমিও জুলিয়েট’- দুর্বল চিত্রনাট্যে সবচেয়ে বেশি ভুগেছে। পরিচালনায়ও খামতি আছে, তুলনামূলক ‘অথৈ’ এ সেটা কম। ‘মন্দার’- এ যেমন সবকিছু অনির্বাণ সামলেছে, তেমনি বাকি দুটোয়ও সে সামলালে ভালো হতো (শুধু সৃজনশীল পরিচালক না থেকে); যেহেতু কলকাতার আধুনিক আর্থসামাজিক চিত্রে শেক্সপীয়র ট্রিলজি নির্মাণ তার স্বপ্নের প্রজেক্ট ছিল।

‘অথৈ’ সবচেয়ে বড় এক্সপেরিমেন্ট করেছে অনির্বাণের গোগো (ইয়াগো) চরিত্রটি দিয়ে সরাসরি ফোর্থ ওয়াল ব্রেক করে ভয়েসওভার ন্যারেটিভ দেওয়ায়, গোটা সিনেমাজুড়েই। দর্শক এবং সমালোচকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরিতে এটা একটা উল্লেখযোগ্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। এই ফোর্থ ওয়াল ব্রেকিং ন্যারেটিভের কারণে সিনেমাটা যে ইন-বিল্ট একটা উইটের জায়গা পেয়েছে, সেটা কোনভাবেই এড়ানো যায় না। সেই জায়গাটা পেয়েছে অনির্বাণের নিজের মধ্যে থাকা দুর্দান্ত রসিক স্বভাবের জন্য। আর কমেন্ট্রিটা দারুণ করে অনির্বাণ। কিন্তু কিছু জায়গায় এই ফোর্থ ওয়াল ব্রেকিং ন্যারেটিভ ক্লেঁদও জাগিয়েছে। সিনেমাটা যেহেতু সিরিয়াস শেষাব্দি। অনেক সমালোচক আপত্তি করেছেন, গল্প ওথেলো বা অথৈ’র কিন্তু সময় এবং গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়েছে গোগো বা ইয়াগোর চরিত্রে। আপত্তি থাকতেই পারে, তবে মনে হয়েছে; সিনেমাটার উদ্দেশ্যই ছিল এমন। ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারটাই তো গোগোকে ঘিরে তৈরি। তার বয়ানে। গোগো বা ইয়াগো, সে মানেই তো অহম; কুটিলতা; দুঃশাসন। সিনেমাটা বক্তব্য রেখেছে দলিত ইস্যুতে, পুঁজিবাদের নোংরামোতে, বিশ্বজুড়ে ঘৃণার চাষ নিয়ে। তাই অনির্বাণকে কেন্দ্র করেই যে এর বয়ান তৈরি হবে সেটা বোঝা যায়। এখানেও নিরীক্ষা করা হয়েছে খারাপের সর্বত্র বিচরণকে সবার উপরে মূর্ত করে। বিশ্বই তো চলছে এভাবে, ‘অথৈ’ সেটাকে ক্রিটিক করেছে।

তবে হ্যাঁ, এতে করে যে চিত্রনাট্যটা ভালো লেখা হয়েছে, তা নয়। সিনেমার নাম তো ‘অথৈ’, ওথেলোই শেষাব্দি কেন্দ্রে। সেই জায়গা থেকে অথৈর নৈতিকতা, তার দ্বন্দ্ব, তার বিক্ষিপ্ত মনোজগৎকে আরো বিশ্লেষণীয় করে তুলবার দরকার ছিল। আরো প্রগাঢ়তা দেবার দরকার ছিল, যেটা হয়নি। দিয়া বা ডেজডেমোনার চরিত্রেও সেটা হয়নি। ওটা একমাত্রিক এবং আরো ফাঁপা। সোহিনীর অভিনয়ও তাই একমাত্রিকতায় জবুথবু হয়ে রইল। রাডু, মুকুল এই চরিত্রগুলোর আরো বিস্তার দরকার ছিল যা হয়নি। গোগোর বাবা, দিয়ার বাবা এই চরিত্রগুলো শুধু চিত্রনাট্যে ফিলার উপাদান হিসবেই এসেছে। এর বাইরে চরিত্রগুলো ঠিক বাস্তবিক হয়ে ওঠেনি।

‘মন্দার’- এ প্রতিটি চরিত্র যেমন যত্ন নিয়ে লেখা হয়েছিল, তেমনটা হলো না। ‘তালমার রোমিও জুলিয়েট’-এ আবার রোমিও-জুলিয়েট ছাড়া বাকিদের চরিত্রে রক্তমাংস কিছুটা জুড়েছিল। যাক। আর ফোর্থ ওয়াল ব্রেক করার ন্যারেটিভটা পাশে রেখে দেখতে গেলে দেখা যায়, অথৈর চিত্রনাট্যে তেমন কিছু নেই। টেক্সটের সাথে সাবটেক্সট অর্থাৎ, ভারী বক্তব্যগুলো সাযুজ্যপূর্ণ অবস্থায় নেই। হ্যাঁ, তীক্ষ্ম কিছু সংলাপে, অনির্বানের মুখে সেসব প্রভাবশালী হয়েছে। কিন্তু ওর বাইরে গল্প ও চিত্রনাট্যের সাথে গাঢ় সম্পর্কটা আর তৈরি করতে পারেনি। শুধু পৃষ্ঠতলের বক্তব্যকেই এড্রেস করে গিয়েছে। আর বাদবাকিটা বেশ গতানুগতিকতায় জড়ানো, পুনরাবৃত্তিতে আঁটকানো। বাণিজ্যিক জায়গা এবং নিরীক্ষাধর্মী আবেদন, দুটোকে একইসাথে ধরতে গিয়ে টোনে সমতা তৈরি করতে পারেনি চিত্রনাট্য, অপুষ্টিতে ভুগেছে।

তবে বয়ানে এবং বক্তব্যেই শুধু এক্সপেরিমেন্টাল হয়নি, ভিজ্যুয়ালিও বেশ এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা ‘অথৈ’। এমন স্বকীয়, চোখ ধাঁধানো ভিজ্যুয়াল সচরাচর বাংলা সিনেমায় দেখা যায় না। (প্রযোজনায় জিও স্টুডিওস যুক্ত থাকায়, এই বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকতে পারে হয়ত।) সিনেম্যাটিক তো বটেই, তারচেয়েও বড় কথা এই অ্যাস্থেটিক্যাল চয়েজ ন্যারেটিভের অর্থ মেনে তাতে গভীরতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং সফলও হয়েছে। শুধু চোখে ধাঁ লাগানোর জন্যই এমন ভিজ্যুয়াল নয়, বরঞ্চ আবহের সাথে মিলিয়ে এর লাইটিং, কালার করা হয়েছে। ওভাবে শট কম্পোজ করা হয়েছে। যথেষ্ট সমৃদ্ধ, আমি বলব। লাইটিং এবং কালারে ওয়ার্ম থেকে আরো হাই কনট্রাস্টে যাওয়া সেখান থেকে আবার কুলার টোন বেছে নেওয়া; প্রতিটা অ্যাস্থেটিক চয়েজই নেওয়া হয়েছে পরিস্থিতি আর চরিত্রের মানসিক অবস্থাকে মাথায় রেখে। অনির্বাণের উপস্থিতিতে, তার ঘরের ডিজাইনে লাল ডমিন্যান্ট রাখা আবার অথৈর ক্ষেত্রে নীল এবং ধূসরাভ শেইড রাখাটা তাদের বিপরীত আইডিওলজি এবং দ্বন্দ্বকেই মূর্ত করে তোলে। সেট ডিজাইনে থিয়েট্রিক্যাল ব্যাপারটা তো রেখেছেই (ওথেলোর শেকড় যেহেতু মঞ্চে), কিন্তু দেখতে হয়েছে পুরোপুরি সিনেম্যাটিক। এমন সুচিন্তিত ভিজ্যুয়াল ডিজাইন এবং ভিজ্যুয়াল মেটাফোর খুব কম বাংলা সিনেমায় চোখে পড়ে। আর সাথে আবহসঙ্গীতও হয়েছে সিনেমার মেজাজ অনুযায়ী, যথাযথ। ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ, আবহসঙ্গীতের পাশাপাশি অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের অপ্রত্যাশিত; সিডি; অমিনাস উপস্থিতি এবং অভিনয়ে ‘অথৈ’ লম্বা হলেও শেষ হয়ে যায় (লম্বা করাটাও উদ্দেশ্যমূলক, কেউ যদি শুরু থেকেই এর গতির উপর নজরটা দেয়, বুঝবে)।

আলোচনা করার মতো উপাদান যেমন দিয়েছে (যেগুলো এখনকার বাংলা সিনেমার স্ট্যান্ডার্ড থেকে অনেক আলাদা এবং স্বকীয়), তেমনি হতাশ হবার মতোও দিয়েছে, অথৈ। তাইতো শুরুতেই বলছিলাম, ‘অথৈ’কে এক কথায় ভালোমন্দে আনা যাবে না। ‘মন্দার’ এইক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হিসেবেই রইল।

অথৈ
পরিচালক: অর্ণ মুখোপাধ্যায়
প্রকাশকাল: ২০২৪

(Visited 9 times, 1 visits today)

Leave a Comment