বাহিরানা

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণকাহিনি পালামৌ: বাংলায় প্রথম সফল ভ্রমণগদ্য


ভ্রমণসাহিত্য নামে আলাদা একটি ঘরানা যে বাংলাসাহিত্যে তৈরি হয়েছে তার অন্যতম কারণ পালামৌ নামক একটি বই। যেটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একই শিরোনামে একটি প্রবন্ধই লিখে ফেলেছিলেন। বইটিকে বাংলাসাহিত্যের প্রথম সফল ভ্রমণকাহিনি বা ভ্রমণগদ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণকাহিনি পালামৌ ব্রিটিশ ভারতের পালামৌ নামের একটি প্রদেশে তাঁর নিজের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। সঞ্জীবচন্দ্রের জন্ম ১৮৩৪ সালে। তিনি সম্পর্কে ছিলেন ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের অগ্রজ। নিজেও ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি পালামৌ নামক বইটির জন্যেই অমর হয়ে আছেন।

কবিতার মতো এবং এরকম নিরাবেগ বর্ণনা পুরো বই জুড়েই আছে। প্রদেশটিতে তার যাত্রারম্ভ থেকে ফেরা পর্যন্তের বর্ণনায় তিনি মোহাবিষ্ট করে রাখেন পাঠকদের। এটি বইটির এক বড় গুণ। আবার সেখানকার মানুষদের জীবনপ্রণালীর বিপরীতে নিজের জীবনকেও তিনি তুলে ধরতে ভুলেন না, অন্যদিকে পালামৌতে তার আচার-আচরণে তখনকার ঔপনিবেশিক কলকাতার মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তসমাজটিও যেন পাঠকদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ইংরেজদের কেতা তারা কতদূর পর্যন্ত গ্রহণ করেছিলেন জানা যায় তা-ও।

পালামৌয়ের গ্রন্থাকারে প্রকাশ নিয়েও কিছু রহস্য রয়েছে, লেখকের জীবনকালে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়নি। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় লেখকের ছদ্মনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটির সম্পাদকও তিনি নিজেই ছিলেন। তার মৃত্যুর পর কনিষ্ঠ ভাই বঙ্কিমচন্দ্র সঞ্জীবচন্দ্রের রচনা সংকলন ‘সঞ্জীবনী সুধা’তে একে প্রথম পুস্তাকার দেন। তবে সেখানে একটি অধ্যায় বাদ পড়ে যায়, মুদ্রণ প্রমাদও ঘটে অনেক। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো একজন সাহিত্যিকের এরকম দায়ীত্বজ্ঞানহীন কাজ আশ্চর্য করে আমাদের। ফলে, ১৩৫১ বঙ্গাব্দ বা ইংরেজি ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎকৃত যে সংস্করণ প্রকাশিত হয় সেটিই এর পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থরূপ।

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণকাহিনি পালামৌ কেন বিশেষ? সাধারণভাবে বলা যায় এর একটি অন্যতম কারণ এর সরস আর নিরাবেগ বর্ণনা, অন্যটি এর ভেতর বয়ে যাওয়া অনি:শেষ কাব্যিকতা। অন্যসব বৈশিষ্ট তো আছেই তবে এই দুই গুণের অনবদ্য মিশ্রণই বইটিকে অনন্যসাধারণ করে তুলেছে।

এবার যাওয়া যাক মূল বইটিতে, পালামৌ ব্রিটিশভারতের সময়কার একটি প্রদেশ, সেই প্রদেশটি সাঁওতাল, কোলসহ বিভিন্ন আদিবাসীদের আবাস। পাহাড়, জঙ্গলঘেরা এই প্রদেশে বিভিন্ন মাংসভোজী এবং তৃণভোজীরাও বসবাস করে এমনকি বাঘেরও দেখা মেলে। সেখানকার প্রকৃতি সভ্যজগতের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন, দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, এরপরেই আকাশছোঁয়া পাহাড়, নিজর্নতার সৌন্দর্য আর হিংস্রতার যৌথতায় পূর্ণ জঙ্গল—ঠিক একইরকম প্রাকৃতিক এর অধিবাসীদের জীবন।

তাদের জীবন সম্মন্ধে জানতে লেখকের কাছ থেকেই শোনা যাক, বইটিতে কোল যুবক-যুবতীদের এক নৃত্যের বর্ণনায় তিনি আমাদের বলছেন, “যুবা দশ-বারোটি, কিন্তু যুবতীরা চল্লিশ জন; সেই চল্লিশ জনে হাসিলে হাইলল্ডের পল্টন ঠকে। হাস্য উপহাস্য শেষ হইলে নৃত্যের উদ্যোগ আরম্ভ হইল। যুবতী সকলে হাত ধরাধরি করিয়া অর্ধচন্দ্রাকৃতি রেখা বিন্যাস করিয়া দাঁড়াইল। দেখিতে বড় চমৎকার হইল। সকলগুলিই সম-উচ্চ, সকলগুলিই পাথুরে কালো; সকলেরই অনাবৃত দেহ; সকলেরই অনাবৃত বক্ষে আর্শির ধুক্‌ধুকি চন্দ্রকিরণে এক-একবার জ্বলিয়া উঠিতেছে। আবার সকলের মাথায় বনপুষ্প, কর্ণে বনপুষ্প, ওষ্ঠে হাসি।”

কবিতার মতো এবং এরকম নিরাবেগ বর্ণনা পুরো বই জুড়েই আছে। প্রদেশটিতে তার যাত্রারম্ভ থেকে ফেরা পর্যন্তের বর্ণনায় তিনি মোহাবিষ্ট করে রাখেন পাঠকদের। এটি বইটির এক বড় গুণ। আবার সেখানকার মানুষদের জীবনপ্রণালীর বিপরীতে নিজের জীবনকেও তিনি তুলে ধরতে ভুলেন না, অন্যদিকে পালামৌতে তার আচার-আচরণে তখনকার ঔপনিবেশিক কলকাতার মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তসমাজটিও যেন পাঠকদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ইংরেজদের কেতা তারা কতদূর পর্যন্ত গ্রহণ করেছিলেন জানা যায় তা-ও।

আবার অবিভক্ত বাংলায় ভ্রমণ কাহিনিটি একসময় কতটা প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠেছিল সেটিও আমরা দেখতে পারি বইটির এই একটিমাত্র উক্তি থেকে, যেমন, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। উক্তিটি আমরা প্রাত্যহিক জীবনে হরহামেশাই বলি।

তবে সঞ্জীবচন্দ্র এরকম গদ্য আর লেখেননি, লিখলে আমাদের সাহিত্যে আরো কিছু মণিমুক্তো যোগ হতো সেটা অনায়াসে বলা যায়। এবিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কথাই যথোপযুক্ত, তিনি সঞ্জীবচন্দ্রের লেখকপ্রতিভা নিয়ে বলেছিলেন,

“তাঁহার প্রতিভার ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু গৃহিণীপনা ছিল না।”

এই প্রতিভার ঐশ্বর্যের সন্ধান পাই আমরা যখন পালামৌয়ের বনের বর্ণনায় তিনি আমাদের শিহরিত করে বলেন,

“শেষ আরও কতদূর গেলে বন স্পষ্ট দেখা গেল। পাহাড়ের গায়ে, নিম্নে সর্বত্র জঙ্গল, কোথাও আর ছেদ নাই। কোথাও কর্ষিত ক্ষেত্র নাই, গ্রাম নাই, নদী নাই, পথ নাই, কেবল বন—ঘন নিবিড় বন।
পরে পালামৌ প্রবেশ করিয়া দেখিলাম নদী, গ্রাম সকলই আছে, দূর হইতে তাহা কিছুই দেখা যায় নাই।”

বইটি নিয়ে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণকাহিনি পালামৌ রহস্য, বিভ্রম, প্রকৃতি আর মানুষের যৌথতার এই অমর ভ্রমণগদ্যটি কখনও হারাবে না। প্রতিবারই নতুন পাঠকদের নতুন পাঠে তাদের মনে জন্ম নেবে তাদের নিজস্ব পালামৌ। একটি সফল বইয়ের কাজ তো এপর্যন্তই, পাঠকদেরকে নিজেদের মনের কাছে ছেড়ে যাওয়া। প্রকাশনাসংস্থা ঐতিহ্য ২৪টি বাংলা ক্লাসিক শিরোনাম প্রকল্পে বইটি নতুন করে প্রকাশ করেছে, সুন্দর বাঁধাই ও প্রচ্ছদে।

পালামৌ
লেখক : সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বিষয় : ভ্রমণ
প্রকাশকাল : ২০২৫
প্রকাশক : ঐতিহ্য
দাম : ১৫০ টাকা।

পালামৌ বইটি কিনতে চাইলে


মন্তব্য করুন