বাহিরানা

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী: নিরাসক্ত বর্ণনায় চিরায়ত জীবনগাথা


বাংলা গদ্যসাহিত্যের ভাষায় নিজস্বতার কথা বিবেচনা করলে যে কয়জন কথাসাহিত্যিক সেটি অর্জন করেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের মধ্যে অন্যতম। তার শব্দে-বাক্যে যেন একটি স্পর্শযোগ্য আবেদন আবার একইসাথে নিরাসক্ত ভাব আছে, এখানে নিরাসক্ত ভাবটি কাহিনী বর্ণনার সময় খুব কাজে দেয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী (প্রথম প্রকাশ, ২৬ আগস্ট, ১৯৫৫) উপন্যাসে আবার এই দুই গুণই বর্তমান। উপন্যাসটি বাংলা ভাষাভাষীদের মনে চিরস্থায়ী স্থান করে নেওয়ার পেছনে এর লেখকের নিরাসক্ত কিন্তু স্পর্শযোগ্য ভাষা একটি প্রধান কারণ। বিভূতিভূষণের সমসাময়িক ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪২ সালে। খানিকটা কালের বিচারেই এত কাছাকাছি সময়ে দুই কালজয়ী উপন্যাস বাংলা সাহিত্য পেয়েছিল। দুইজনই জীবনকে গভীরভাবে দেখেছিলেন। এর ছাপ পাওয়া যায় উপন্যাস দু’টিতে।

উপন্যাসটির নামের মধ্যে একটি পথ আছে আর সেখানে যে গ্রাম আছে তার নাম নিশ্চিন্দপুর, এর মানে নিশ্চিন্ত, যেখানে কোনো চিন্তা নেই। যেন অবিরল সুখের পৃথিবী এই গ্রাম। শৈশবে কী জীবনের জটিল-কুটিল দুশ্চিন্তা থাকে আদতেই? না, কারণ এই সময় আবিষ্কারের আনন্দ সব শিশু-কিশোরকে মত্ত করে রাখে। অন্য কোনো চিন্তা করার সময় নেই তখন, যেমন, অপু-দুর্গার পরিবার তাদেরকে পরিপূর্ণ স্বাচ্ছন্দ দিতে পারে না, কিন্তু এ নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই। কিন্তু উপন্যাসের “পথ”টি কোথায়? পথ তৈরি হয় তখন যখন দুর্গা অপুকে ছেড়ে যায় বিশাল একা পৃথিবীতে একা, যেখানে তার একা একাই বাঁচতে হবে, সংগ্রাম করে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালি উপন্যাসের বিষয়বস্তু এমন, নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের দুই ভাইবোন অপু-দুর্গার জীবনের গল্প নিয়ে এই উপন্যাস। তাদের বাবার নাম হরিহর সাধারণ গৃহস্থ, তারা থাকে এক কোঠা বাড়িতে। হরিহরের বাবার রেখে যাওয়া সামান্য জমিজমা ও কয়েকঘর শিষ্যের প্রণামীর মাধ্যমে তাদের সংসার চলে। ইন্দির ঠাক্‌রুণ নামে হরিহরের এক দূর সম্পর্কের দিদিও থাকে তাদের সাথে। ইন্দির ঠাক্‌রুণ নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের সবকিছুই দেখেছে। এই গ্রামে চণ্ডীমণ্ডপ, আমগাছের বাগান, তেতুল গাছ, পুকুর, সবুজের সমাহার সবই আছে। চিরকালীন বাংলার গ্রাম বলতে যা বোঝায় পথের পাঁচালী’র নিশ্চিন্দিপুর যেন তাই। ইন্দির ঠাক্‌রুণ স্বামী হারিয়ে ভাইয়ের সংসারে ছিল প্রথম, অকালে ভাই মারা যাওয়ার পর এরপর হরিহরের বাবা রামচাঁদ-এর আশ্রয়ে আসে। তার পর রামচাঁদ-এর মৃত্যুর পর হরিহর-এর আশ্রয়ে আছে এতকাল। এই গ্রামে মুখুজ্যে, চক্রবর্তী, রায় গোত্রের মানুষদের বাস। সবকিছু দেখেশুনে তার বয়স পচাত্তর হয়েছে। সে দুর্গাকে দুইচোখের আড়াল করতে পারে না, দুর্গার মধ্যে তার নাড়ি পোতা।

উপন্যাসের একদম শুরুতে আমরা জানতে পারি দুর্গার বয়স ছয় বছর। অপু-দুর্গা ও তাদের বাবা-মা ও ইন্দির ঠাক্‌রুণ এই পাঁচজনের সংসার তাদের। তাদের নির্মল শৈশবের একসাথে চারপাশের সবকিছুকে আবিষ্কারের ঘটনাগুলোর বর্ণনা এবং একইসাথে তাদের বাবার জীবন, গ্রামের মানুষজনের জীবন, এসবই উঠে আসে আখ্যানটিতে। তবে একদিন দুই ভাইবোনের বিচ্ছেদ ঘটে, আর সেটি চিরতরের। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে দুর্গার জ্বর আসে, আর তাতেই হঠাৎ সে মরে যায়। জীবনের অপরূপ সৌন্দর্য সে পেছন ফেলে যায়। ফেলে যায় আদরের খেলার সাথী ভাই অপুকেও। দুর্গার এই আকস্মিক মৃত্যুতে তখন অপুর মনে যে প্রচণ্ড বোবা অভিঘাত আসে সেটি আমাদেরও দখল করে নেয়, কেননা বুদ্ধের মতে সুখই দুঃখে রূপ নেয়, দুর্গার সাথে কাটানো সুখের সময়গুলো তখন কেবলই দুঃখে রূপ নিয়েছে।

তাদের বাবা হরিহর তখন বাড়িতে ছিল না। কাজের আশায় বিভিন্ন শহরে শহরে ঘুরছিল।  পূজার ছুটি আসে তখন তার মেয়ে দুর্গা লালপাড় কাপড় খুব পছন্দ করে, হরিহর তাই দুর্গার জন্য লালপাড়ের কাপড়, আলতা, কিছু বই ও খেলনা কিনে খুব আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফেরার পর হরিহর যখন জানতে পারে তার অতি আদরের মেয়ে আর নেই, তখন তার মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। বিভূতিভূষণ পথের পাঁচালির ৩৫ অধ্যায়ে আমাদের এক অমূল্য পৃথিবীর সাক্ষাৎ করান, যে পৃথিবী সুখের তবু দুঃখের, যে পৃথিবী হাসির তবু অশ্রুরও, যে পৃথিবী পাওয়ার আনন্দে উচ্ছল সে আবার হারানোর বেদনায় পাষাণ। এই উপন্যাস তাই চিরকালের জীবনের ক্ষয়হীন বিষয়গুলোকে ধারণ করে আছে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাসটির নামের মধ্যে একটি পথ আছে আর সেখানে যে গ্রাম আছে তার নাম নিশ্চিন্দপুর। এই নিশ্চিন্দি’র অর্থ নিশ্চিন্ত, মানে যেখানে কোনো চিন্তা নেই। যেন অবিরল সুখের পৃথিবী এই গ্রাম। মানব জীবনের এই নিশ্চিন্ত সময়ের অপর নাম শৈশব। শৈশবে কী জীবনের জটিল-কুটিল দুশ্চিন্তা থাকে আদতেই? না, কারণ এই সময় আবিষ্কারের আনন্দ সব শিশু-কিশোরকে মত্ত করে রাখে। অন্য কোনো চিন্তা করার সময় নেই তখন। যেমন, অপু-দুর্গার পরিবার তাদেরকে পরিপূর্ণ স্বাচ্ছন্দ দিতে পারে না, কিন্তু এ নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই। কারণ শৈশবই তাদের দখল করে রেখেছে।

নিশ্চিন্তের মানে তো পেলাম কিন্তু উপন্যাসের ‘পথ’টি কোথায়? পথ তৈরি হয় তখন যখন দুর্গা অপুকে ছেড়ে যায় বিশাল এক পৃথিবীতে একা। যেখানে তার একা একাই বাঁচতে হবে, সংগ্রাম করে। তখন হঠাৎ করে জীবন পূর্ণভাবে অপুর মনে এসে ভর করে, বা অপু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায়। অপুর এই মানসিক দ্বন্দ্ব, হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়া বিভূতিভূষণের আরেকটি স্বল্পপরিচিত উপন্যাস দৃষ্টিপ্রদীপ-এর ‘জিতু’ চরিত্রেও সাক্ষাৎ মেলে ভিন্ন পরিসরে। মানুষ যেভাবে বৃহৎ জীবনে প্রবেশ করে, বিভূতিভূষণের অপু যেন তারই এক মর্মান্তিক প্রতীক। ফলে উপন্যাসটির বিষয়বস্তু এর নামের সঙ্গে সার্থকভাবে খাপ খেয়েছে। মহাকাব্যিকও হয়ে ওঠে।

বিস্ময়ের বিষয় এই যে, লেখক বিভূতিভূষণ নিরাসক্তভাবে খুঁটিনাটিসহ বর্ণনা করে গেছেন এই সবকিছু। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোস্টমাস্টার গল্পের অবিস্মরণীয় উক্তিটি স্মরণে আসে, “কোথায় যেন বেদনা রহিয়া গেল”। এটাই ভাষায় অনুভূতির স্পর্শযোগ্যতা, যা মহৎ লেখকদেরই গুণ। আর এর ফলেই, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী বাঙালির মনে আসন নিয়েছে।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় তার সাহিত্যের মাধ্যমে তার পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকদের কাছেও পৌঁছাতে পেরেছেন সফলভাবে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শেখ লুৎফর বাহিরানা Talk -এ  তার প্রিয় সাহিত্যিকদের তালিকায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম নিয়েছেন। আরেকজন লেখক হামীম কামরুল হকও বাংলাসাহিত্যের ধারাবাহিকতায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করেছেন তার সাক্ষাৎকারে।

পথের পাঁচালী
লেখক: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিষয়: উপন্যাস
প্রকাশকাল: ২০২৪ (পাঠক সমাবেশ সংস্করণ)
প্রকাশক: পাঠক সমাবেশ
মূল্য: ৩৫০ টাকা।

পথের পাঁচালী বইটি কিনতে চাইলে


মন্তব্য করুন