বাহিরানা

শামীম রফিকের ভিলানেল: এক বিষণ্ন সময়ের গান বই রিভিউ: বিরল প্রকরণের কাব্যগ্রন্থ


অমিত হাসান

শামীম রফিকের ভিলানেল: এক বিষণ্ন সময়ের গান

ভিলানেল—কবিতার একটি বিশেষধারা। পৃথিবীতে বিভিন্নরকম প্রকরণ এসেছে কবিতার, আর কবিতাপ্রেমী মানুষকে কবিতার সবরকম প্রকরণ বা ধারা আকর্ষন করেছে। ভিলানেল-এর প্রচলন প্রায় নেই বললেই চলে। ‘ভিলানেল’ কবিতার সেই বিশেষ প্রকরণ, যা আজ বিরল প্রকরণ বলেই পরিচিত। বাংলা সাহিত্যে ভিলানেল নিয়ে তেমন কোন কাজ হয়নি পূর্বে, দু’জন কবির একটি করে ভিলানেল ছাড়া আর কেউ কোন ভিলানেল লিখেননি। যদিও এ কথা আগে ঠিক থাকলেও এখন তা আর নেই। কারণ সম্ভবত বাংলাভাষায় ভিলানেল সম্পর্কিত একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতার বই বাংলাদেশে প্রকাশ পেয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার সেটি আবার মৌলিক ভিলানেল।

যারা জানেন না বা শোনেননি এ সম্পর্কে, ভিলানেল-এর কথা শুনলেই অবাক হতে হতো তাদের। যারা সাহিত্যবোদ্ধা, যারা ভাল ও বড় কবি থেকে শুরু করে সাহিত্যের বিভিন্নমাধ্যম এবং গণগ্রন্থাগার অনেককিছুতে ভিলানেল-এর সম্পর্কে সন্ধান দিতে পারেন। কেবল বিষ্ণু দে একটি এবং সিকদার আমিনুল হক একটি করে ভিলানেল লিখেছেন এটিই জানা।

কিন্তু আজ যে বইটির কথা বলছি, সেটি বাংলাভাষার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভিলানেলের বই—ভিলানেল: এক বিষণ্ণ সময়ের গান, লিখেছেন কবি শামীম রফিক। ভদ্রলোক পিএইচডি গবেষণা করতে গিয়েই ভিলানেল-এর প্রতি আগ্রহী হন গ্রন্থভূমিকাতে তা জানা যায়। তারপর আশ্চর্য এ কবিতার ফর্মের প্রেমে পড়ে যান কবি, লিখতে থাকেন একের পর এক ভিলানেল। এক সময় এটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থে রূপ নিয়ে কবিমানস প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পেয়েছে। গ্রন্থটি এক আশ্চর্য সংগ্রহ কবিতাপ্রেমী পাঠকের জন্য। এখন বিরল ভিলানেল-এর গঠন-বৈশিষ্ট্য কেমন এবং ভিলানেল(Villanelle) কী এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জেনে নিই :
A chiefly French verse form running on two rhymes and consisting typically of five tercets and a quatrain in which the first and third lines of the opening tercet recur alternately at the end of the other tercets and together as the two lines of the quatrain. Otherwise, 19-lines with five tercets and a final quatrain with two repeating lines.

ষোড়শ শতকে প্রথমে শিল্পসমৃদ্ধ দেশ ফ্রান্সে প্রচলিত হয়েছিল এক ধরনের গীতিকবিতা, যা পরবর্তীকালে ভিলানেল নামে পরিচিত। ভিলানেলে থাকে উনিশটি লাইন পাঁচটি তিন-পংক্তির স্তবক (tercet) ও একটি চতুষ্ক-এ (quatrain) গঠিত। প্রথম পাঁচটি তিন-পংক্তির স্তবকের মিলবিন্যাস হতো কখক। এছাড়া প্রথম স্তবকের প্রথম ও তৃতীয় পংক্তি পরবর্তী তিন-পংক্তি স্তবকগুলির তৃতীয় পংক্তি হিসেবে পর্যায়ক্রমে ব্যবহৃত হতো এবং চতুষ্কের শেষ দুটি পংক্তি হিসেবে পরপর বিন্যস্ত হতো। (অর্থ্যাৎ প্রথম স্তবকের প্রথম লাইন দ্বিতীয় স্তবকের তৃতীয় লাইন, প্রথম স্তবকের তৃতীয় লাইন তৃতীয় স্তবকের তৃতীয় লাইন, চতুর্থ স্তবকের তৃতীয় লাইন প্রথম স্তবকের প্রথম লাইন, পঞ্চম স্তবকের তৃতীয় লাইন প্রথম স্তবকের তৃতীয় লাইন এবং চতুষ্ক-তে শেষ দুই স্তবক প্রথম স্তবকের প্রথম ও তৃতীয় লাইন হিসেবে ব্যবহৃত হবে।)

সেকালে ভিলানেল-এর সুনির্দিষ্ট রূপটি কৃষক এবং রাখালের গান হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিল। এই ফরাসি গ্রাম্য-গীতিকার আঙ্গিকের মূলে ছিল প্রাচীন ইতালীয় লোকগান। ষোড়শ শতকের গ্রাম্য ফরাসি কবি জাঁ প্যাসরে এই আঙ্গিক ব্যবহার করেন। একই সময়ে য়্যাকব রেগনার্টের ভিলানেলগুচ্ছ জার্মান কবিতাতেও সাড়া ফেলেছিল। আধুনিক কবিদের মধ্যে অডেন, উইলিয়াম এম্পসন, ডেরেক ম্যাহন, ডিলান টমাস প্রমুখ এই রীতিকে গ্রহণ করেছিলেন। ডিলান টমাসের কবিতা Do Not Go Gentle Into That Good Night -ভিলানেল-এর চমৎকার একটি উদাহরণ:

Do not go gentle into that good night,
Old age should burn and rave at close of day;
Rage, rage against the dzing of the light.

Though wise men at their end know dark is right,
Because their words had forked no lightning they
Do not go gentle into that good night.

Good men, the last wave by, crying how bright
Their frail deeds might have danced in a green bay,
Rage, rage against the dzing of the light.

Wild men who caught and sang the sun in flight.
And learn, too late, they grieverd it on its way,
Do not go gentle into that good night.

Grave men, near death, who see with blinding sight
Blind eyes could blaze like meteors and be gay,
Rage, rage against the dzing of the light.

And you, my father, there on the sad height,
Curse, bless, me now with your fierce tears,
I pray. Do not go gentle into that good night

Rage, rage against the dzing of the light.

ভিলানেল আঙ্গিকে বাংলাভাষার কবিদের মধ্যে বিষ্ণু দে কবিতা রচনা করেন। তাঁর নাম রেখেছি কোমল গান্ধার কাব্যের অন্তর্গত ‘ভিলানেল’ কবিতাটি সুর ও বাণীর সার্থক সমন্বয়ে এক অসামান্য প্রেমের কবিতা। ষাটের কবি সিকদার আমিনুল হক সুলতা আমার এলসা  কাব্যগ্রন্থে ‘একটি ভিলানেল’ শিরোনামে কবিতা রচনা করেছেন। এই কবিতাটিতে তিনি প্রথম পাঁচটি স্তবকের প্রতিটিতে তিনটি করে লাইন সন্নিবেশ করেছেন এবং শেষের স্তবকে চারটি লাইন রয়েছে। এই কবিতাটি ভিলানেল-এর গঠনগত সকল সূত্র ধারণ করেছে। এছাড়াও পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল কাব্যগ্রন্থে ‘একটি ভিলানেল’ শিরোনামে তিনি একই কবিতা সন্নিবেশ করেছেন—তা কেন করেছেন সে ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। যেমন—

ভিলানেল
বিষ্ণু দে

দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে
সে কার হাওয়া আনে বনের নীল ভাষা।
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।

আলোর ঝিকিমিকি তোমার কালো চুলে,
উষার ভিজে মুখে দিনের স্মিত আশা,
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে

পরশ মেলে-মেলে তুমি যে ধরো খুলে,
হৃদয় সে-ঊষায় থামায় যাওয়া-আসা,
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।

কে খোঁজে পথে আর কে ঘোরে পথ ভুলে;
অন্ত গোধুলিকে সে সাধে দুর্বাসা
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে?

ঈশান মেঘে আর ওঠে না দুলে-দুলে
ত্বরিতে কাঁদা আর চকিতে মৃদু হাসা
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।

সে তরু এ-হৃদয়, তুমি যে-তরুমূলে
বসেছে ফুলসাজে, ছায়ায় দাও বাসা
দিনের পাপড়িতে রাতের রাঙা ফুলে
জোগায় কথা তাই সোনালি নদী-কূলে।

কবিতার নতুনত্ব আবিষ্কার করতে পারলেই কবির যে আনন্দ তা বিষ্ণু দে’র কবিতা পাঠে চমকে যেতে হয়। এ এক অসামান্য প্রেমের কবিতা রচেছেন বিষ্ণু দে।

একটি ভিলানেল
সিকদার আমিনুল হক

তোমার মিলনের আশায় পরবাসী।
দাঁড়াই যতবার তৃষিত আলো জ্বেলে
বিশদ ছায়া আনো চকিতে পাশাপাশি।

হ্রদের নীল-চোখে বিবাদ রাশি রাশি,
তুহিন মর্গের বিরূপ ঘ্রাণ ঠেলে
তোমার মিলনের আশায় পরবাসী।

শিয়রে বিফলতা তবু তো ভালোবাসি-
শস্তা বায়বীয় তোমাকে কাছে পেলে
বিশদ ছায়া আনো চকিতে পাশাপাশি।

ঘাতক জীবনের যদিও কাছে আসি,
দীপ্র মরীচিকা আশার আলো ফ্যালে,
তোমার মিলনের আশায় পরবাসী।

তোমার স্বপ্ন কি রাজার সেই ছেলে?
কৃতীতে উজ্জ্বল, শতেক দাসদাসী?
বিশদ ছায়া আনো চকিতে পাশাপাশি।

জাগবে সাত ভাই পারুল কাছে গ্যালে
যেমন তুমি ভাবো, সে-যুগ আজ বাসি,
তোমার মিলনের আশায় পরবাসী-

বিশদ ছায়া আনো চকিতে পাশাপাশি।

ভিলানেল এত কম লেখা হয়েছে বাংলাভাষায় যে সিকদার আমিনুল হক ব্যবহার করেছেন ‘একটি ভিলানেল’ শিরোনাম, কিন্তু সেটি আর এখন নেই। কারণ আলোচ্য গ্রন্থ ‘ভিলানেল এক বিষণ্ন সময়ের গান’, ৮০ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থে সব মিলিয়ে সংখ্যায় চৌষট্টিটি ভিলানেল যুক্ত করেছেন শামীম রফিক। ভাবনাহীন তিনি লিখে গেছেন, যেন ছন্দপতনের কোনরকম সম্ভাবনাই তার ছিল না, পূর্বপ্রস্তুতি পূর্ণযোগে লব্ধ দুঃসাহসী তার এ ভিলানেল যাত্রা। এখানে পাঠকদের উদ্দেশ্যে শামীম রফিকের ভিলানেল: এক বিষণ্ন সময়ের গান কবিতাবই থেকে দুইটি সম্পূর্ণ ভিলানেল কবিতা পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম,

চৌদ্দ

পাথর হই আর মানুষ
হৃদয়ে থাকে আগুন
চিবুকের জল হাহাকার হয়ে রাত্রিশেষে মিশবে জনপদে।

অন্তরালের সুখ অভিন্ন রেখে, ওখানে জমা হয় মেঘ, ভয়ার্ত
আলো জ্বেলে রাত। মৃত্যু বুঝি না সরোবর
পাথর হই আর মানুষ।

মুকুটে কেউটে নিয়ে কেউ কাউকে ভাসে না ভালো, কোথায়
বসব- পাথরের গায়ে কচকচে ঝিনুক
চিবুকের জল হাহাকার হয়ে রাত্রিশেষে মিশবে জনপদে।

বইয়ের পাতার চিতা ক্রমশ শাসায়, ভয়ে থাকে না কোন
পরিত্রাণ। পাথরের পাতায় থাকে নিঃস্ব জীবনপুঞ্জী
পাথর হই আর মানুষ।

কোথায় দাঁড়িয়েছে প্রহর পেইন্টিংস্ হয়ে
বহুকাল পর জমেছে আহারের নানাবিধ মুদ্রা
চিবুকের জল হাহাকার হয়ে রাত্রিশেষে মিশবে জনপদে।

মনে হয় হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত রোদ থেকে
বহু দূরে, আমি যাযাবর- পাথরের উপর বসে ছিল যারা
পাথর হই আর মানুষ
চিবুকের জল হাহাকার হয়ে রাত্রিশেষে মিশবে জনপদে।

১৭.০৪.২০২০

নয়

বিষাদের শরীরে লেগে আছে কল্পনার বীজ
বৃষ্টিগুলো আমাকে দিয়ে
উচ্ছ্বাসগুলো আনন্দময় হোক কিছুটা সতর্কতায়।

জীবনের স্তরে স্তরে জমে গেলো রাত্রি আর রমনীর ফাঁদ
ঘুমের বিনিময়ে থ্যাঁতলে গিয়ে বিষ করেছি পান
বিষাদের শরীরে লেগে আছে কল্পনার বীজ।

নারীরা জন্মাবার আগেই গিলে নিলো বজ্রপাত
প্রথম কোমলতা বুঝতেই দেয়নি
উচ্ছ্বাসগুলো আনন্দময় হোক কিছুটা সতর্কতায়।

চোখের আলো বিচ্ছিন্ন হবার কারনেই
ঝাউগাছ, তরুলতা পুড়েছে, পুড়েছে প্রথম কম্পন
বিষাদের শরীরে লেগে আছে কল্পনার বীজ।

রক্তের লাল অনেকটা বদলে গেছে
মানুষের কাছে সম্পর্কের তস্কর
উচ্ছ্বাসগুলো আনন্দময় হোক কিছুটা সতর্কতায়।

আমাদের নীরবতা খেয়েছে নক্ষত্রের ভূত
এখন বলতেই হবে যা বলার জন্য আমরা এসেছি
বিষাদের শরীরে লেগে আছে কল্পনার বীজ
উচ্ছ্বাসগুলো আনন্দময় হোক কিছুটা সতর্কতায়।

১৪.০৪.২০২০

আগ্রহী পাঠক যারা কবিতার বিরল এ প্রকরণের কথা জানেন, তারা পাঠ করে নিতে পারেন, কবিতার নতুন এ প্রকরণকেও—ভালোবেসে নেবেন নিশ্চয়ই। কেননা, কবিতার ভেতর এত মুগ্ধতা রয়েছে, সত্যি অবাক হওয়ারই বিষয়। শুভেচ্ছা কবিকে, শুভকামনাও কবির জন্য।

ভিলানেল: এক বিষণ্ন সময়ের গান
কবি: শামীম রফিক
প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২০
প্রকাশন: কবি মানস
দাম: ৩০০ টাকা


মন্তব্য করুন