সবাই পড়ে কিন্তু সবাই পাঠক নয়, আবার পাঠকদের মধ্যে সবাই ভালো পাঠক নয়। পাঠ একটি গুণ লেখালেখির মতোই যা ক্রমাগত চর্চায় আয়ত্ত করা যায়। একজন দৌড়বিদ যেমন প্রতিদিন অনুশীলন করেন তেমনি একজন পাঠককেও অনুশীলন করতে হয়। কিন্তু কীভাবে তিনি পড়বেন, কোন মাধ্যমে (বই, ই-বুক, অডিও বই) পড়বেন—এগুলোই তার দক্ষতার পরিমাণ বাড়াতে বা কমাতে পারে। যদি একজন পাঠকের জানা থাকে পড়ার কার্যকর পদ্ধতিগুলো তাহলে তিনি ভালো পাঠক হয়ে উঠতে পারেন। আমরা এখানে ভালো পাঠক হওয়ার ৬টি উপায় তুলে ধরলাম, যা পঠিত বিষয়কে আত্তীকরণের সঙ্গে সঙ্গে আপনার চিন্তাভাবনা বদলাতেও সাহায্য করবে। বর্তমান পৃথিবীতে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। কোনো বিষয়ে জানতে বা অন্য দশজনের চেয়ে এগিয়ে থাকতে হলে আপনাকে পড়তেই হবে। পড়াই একজনের সাথে আরেকজনের ব্যবধান তৈরি করে যোগ্যতা ও দক্ষতার। তবে ব্যস্ততম এই সময়ে পড়া খুব একটা সহজ কাজ নয়, পড়ার এই পদ্ধতিগুলো আপনার সময়কে বিবেচনায় নিয়েই তৈরি করা হয়েছে। যাতে আপনি মানিয়ে নিতে পারেন।
ভালো পাঠক হওয়ার ৬টি উপায় লেখাটি টিনা জর্ডানের How to Be a Better Reader প্রবন্ধের ভাবানুবাদ। লেখাটি দ্য নিই ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় অক্টোবর ২৬, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি, ২০২০। লেখাটিকে বাংলাদেশি পাঠকদের উপযোগী করে তৈরি করতে মূলের কিছু অংশ সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি মূল শিরোনামও বদল করা হয়েছে।
১. সঠিক বই বেছে নিন
ভালো পাঠক হতে চাইলে প্রথমে প্রয়োজন একটি ভালো বই। আপনার বাড়িতে যদি ইতোমধ্যে পড়ার মতো বই থাকে, তাহলে ভালো। না থাকলে নিজের প্রতি কয়েকটি প্রশ্ন করুন:
– আপনি কিসের জন্য পড়তে চান, আনন্দের জন্য নাকি জ্ঞানার্জনের জন্য?
– নিজের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য? কোনোভাবে নিজেকে চ্যালেঞ্জ করতে চান?
– বাস্তবতা থেকে পলায়ন করতে চাচ্ছেন কী?
– আপনি কী বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় কোনো বইয়ের আলোচনায় অংশ নিতে চাচ্ছেন?
– জনপ্রিয় বইয়ের তালিকার শীর্ষে থাকা বইগুলো কি আপনার কৌতূহল জাগায়?
উদাহরণ হিসেবে, আপনি যদি জনপ্রিয় জীবনী বইয়ের পাঠক হন তাহলে শাহাদুজ্জামানের একজন কমলালেবু পড়ার জন্য বেছে নিতে পারেন। জীবনীগ্রন্থের ভক্ত হলে বেছে নিন বিধান চন্দ্র দাসের বিজ্ঞানী মেরি কুরি’র জীবনীগ্রন্থ মেরি কুরি বা ভিন্নস্বাদের জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই পড়তে চাইলে বেছে নিন লিসা ফেল্ডমেন ব্যারেটের মস্তিষ্ক সম্পর্কে সাড়ে সাত পাঠ। শব্দ নিয়ে আগ্রহী হলে পড়তে পারেন আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে ব্যবহৃত পৌরাণিক শব্দের মূল অর্থ নিয়ে জ্যোতির্ময় সেনের পৌরাণিক শব্দসন্ধান বইটি।
উত্তর যাই হোক না কেন, এই সপ্তাহে একটি বই বেছে নিন। বই কিনতেই হবে এমন নয়—শেল্ফ থেকে কিংবা বন্ধুর কাছ থেকে বই ধার নিন, লাইব্রেরি থেকে নিন বা অনলাইন থেকে পিডিএফ কপি ডাউনলোড করুন।
বই পড়া আমাদের মস্তিষ্কে নতুন নতুন পথ তৈরি করে। এমোরি ইউনিভার্সিটির গবেষণা অনুযায়ী, বই পড়া শুধু ভাষা নয়, শারীরিক অভিজ্ঞতাও তৈরি করে। যেমন, দৌড়ানোর বর্ণনা পড়লে আপনার মস্তিষ্কের নিউরনগুলি বাস্তবের দৌড়ানোর মতো করে সাড়া দেয়!
আর যদি সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়:
– বন্ধুদের পাঠ্যতালিকা বা অনলাইনে বিখ্যাত পাঠকদের (যেমন বিল গেটস, বারাক ওবামা, ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূস, নেলসন ম্যান্ডেলা) বইয়ের তালিকা দেখুন।
– লাইব্রেরি বা বইয়ের দোকানে বইয়ের তালিকা দেখুন।
অনুপ্রেরণা:
বই পড়া আমাদের মস্তিষ্কে নতুন নতুন পথ তৈরি করে। এমোরি ইউনিভার্সিটির গবেষণা অনুযায়ী, বই পড়া শুধু ভাষা নয়, শারীরিক অভিজ্ঞতাও তৈরি করে। যেমন, দৌড়ানোর বর্ণনা পড়লে আপনার মস্তিষ্কের নিউরনগুলি বাস্তবের দৌড়ানোর মতো করে সাড়া দেয়!
২. পড়ার পরিকল্পনা তৈরি করুন
পড়াকে জীবনের অংশ করতে পরিকল্পনা প্রয়োজন। লক্ষ্য যত স্পষ্ট, সাফল্যের সম্ভাবনা তত বেশি। স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. মার্ক মার্ফির মতে, “আপানার লক্ষ্যকে খাতায় লিখলে সেটির সফলতার হার ১.২-১.৪ গুণ বেড়ে যায়!”
পরিকল্পনার জন্য কিছু পরামর্শ:
সময় বরাদ্দ করুন:
প্রতিদিন ৩০ মিনিট বা ১ ঘণ্টা পড়ার জন্য সময় বরাদ্দ করুন। ক্যালেন্ডারে সেই রুটিন যোগ করুন।
না পড়ার স্বাধীনতা দিন নিজেকে: যদি কোনো বই ৫০ পৃষ্ঠার পড়ার পরেও আগ্রহ না জাগে, বই বদলান।
পড়ার সঙ্গী খুঁজুন:
বন্ধুদের সাথে বা পরিবারের কারো সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পড়ুন।
আজীবনের লক্ষ্য:
সপ্তাহ, মাস বা বছরে নির্দিষ্ট সংখ্যক বই পড়ার লক্ষ্য রাখুন। গুডরিডস বা বুক রায়ট-এ চ্যালেঞ্জ নিন।
বিভিন্ন ঘরানার বই, যেমন—ইতিহাস, ফিকশন, নন-ফিকশন, কবিতা—পড়ুন।
যেমন, বাংলাদেশের চমকপ্রদ ইতিহাসের বই ভেলাম ভান সেন্দেলের সম্পাদনায় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকানন (১৭৯৮) পড়তে পারেন, বা তরুণ চিন্তক ও অনুবাদক ফজলে রাব্বীর চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের জীবন ও চলচ্চিত্র নিয়ে বই মৃণাল সেন: জীবন ও সিনেমা বেছে নিন। মেটকথা পড়ায় বৈচিত্র আনুন, এতে একঘেয়েমি কাটবে।
অনুপ্রেরণা:
শান্ত নিরিবিলি একটি পরিবেশ তৈরি করুন—মোবাইলের নোটিফিকেশন বন্ধ করুন, হেডফোন ব্যবহার করুন। এরকম পরিবেশে পড়া আমাদের দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন কমায়।
৩. গভীরভাবে পড়ুন
মোবাইল, ল্যাপটপের দ্রুত স্ক্রলিংয়ের এই ব্যস্ত যুগে গভীর পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলতে ধীরে-সুস্থে পড়ুন। জেডি স্মিথের মতে, “পড়া হচ্ছে একপ্রকার অনুশীলন—এতে আপনি যতটা বিনিয়োগ করবেন, ততটাই পাবেন।”
গভীরভাবে পাঠের কিছু পরামর্শ:
– পড়া থেকে পলায়ন না করে আঙুল দিড়ে বাক্য স্পর্শ করে পুড়ুন।
– সঙ্গে অভিধান রাখুন, কোনো শব্দের অর্থ না জানলে তাতে খুঁজুন।
– কঠিন অংশ পুনরায় পড়ুন বা হাইলাইট করুন।
– প্রতিবার একটি নির্দিষ্ট বিষয় পড়ার শেষে এর সারাংশ লিখুন।
অনুপ্রেরণা:
বই আপনাকে অন্য মানুষের অনুভূতি বুঝতে সাহায্য করে, সহমর্মিতা বাড়ায়।
৪. সমালোচনামূলকভাবে পড়ুন
বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন করুন:
লেখক কী বলতে চেয়েছেন? তার বক্তব্যের সঙ্গে আমি কি একমত? বইটির লেখার আঙ্গিক কীভাবে আমার উপর প্রভাব ফেলেছে? পড়ার সময় নিজের কাছে এই প্রশ্নগুলো করুন। এতে পঠিত বিষয়ের গভীরে পৌঁছানো সহজ হয়, নিজস্ব মতামত তৈরি করাও সহজ হয়।
(নতুর ঘরানার কবিতা বা গল্পের বই পড়তে পারেন, যেমন, বাংলা ভাষায় ভিলানেল আঙ্গিকে প্রথম কাব্যগ্রন্থ শামীম রফিকের ভিলানেল: এক বিষণ্ন সময়ের গান বইটি পড়তে পারেন।)
পরামর্শ:
বইয়ের মার্জিনে মন্তব্য লিখুন, লেখকের যুক্তি যাচাই করুন, পঠিত বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত বই খুঁজুন। এতে ওই বিষয়ের একটি সামগ্রিক জ্ঞান আয়ত্ত করা সহজ হয়। বিশেষজ্ঞরা আদতে তাই করেন। তারা শুধু একটি বই পড়েন না, এর সঙ্গে সম্পর্কিত সব বই পড়তে চেষ্টা করেন।
বিভিন্ন মাধ্যমে পড়ার সঙ্গে নিজেকে অভ্যস্ত করুন
ই-বুক, ফোন:
কিন্ডলে বা অভারড্রাইভ অ্যাপ ব্যবহার করুন।
অডিওবুক:
কাজের সময় শুনুন।
যখন যে মাধ্যম ভালো লাগে সেটি ব্যবহার করুন: প্রিন্ট, ডিজিটাল ও অডিওর মিশ্রণ তৈরির চেষ্টা করুন।
৫. সামাজিকভাবে পড়ুন
বইয়ের ক্লাব বা অনলাইন কমিউনিটিতে যোগ দিন:
– গুডরিডস, ফেসবুক গ্রুপ—এসব জায়গায় নিজেকে অভ্যস্ত করুন। এখানে আপনার সমমনা অনেককে পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
– স্থানীয় গ্রন্থাগারের বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নিন।
অনুপ্রেরণা: বই মানসিক চাপ কমায় এবং একাকীত্ব দূর করে। ওয়েলসের “বুক প্রেসক্রিপশন” প্রোগ্রাম এর উদাহরণ।
বই শেষ করার পর
পড়ার জার্নাল তৈরি করুন:
এখানে পড়া বইয়ের তালিকা রাখুন।
স্বাচ্ছন্দের জায়গা থেকে বের হন:
নতুন নতুন ঘরানার—যেমন, গ্রাফিক নভেল, যুদ্ধসময়ের ডায়েরি—বই পড়তে চেষ্টা করুন। এটা অনেক উপকার দেবে কারণ এতে আপনার একঘেয়েমি দূর হবে।
– প্রিয় লেখকের সব বই পড়ুন।
৬. বই বোদ্ধা হয়ে উঠুন
– বিভিন্ন সাহিত্য ওয়েবসাইট (আন্তর্জাতিক দ্য মিলিয়নস, বুক রায়ট, দেশীয় যেমন, প্রথম আলো, প্রতিধ্বনি), পডকাস্ট, বই রিভিউ সাইট ও সাক্ষাৎকার (বাহিরানা) এবং লেখকদের ব্লগ ফলো করুন।
সর্বশেষ অনুপ্রেরণা:
বই কেবলই জ্ঞান দেয় না, জীবনের গতিপথও বদলে দেয়। আজই পড়া শুরু করুন, পৃথিবীকে নতুন চোখে দেখুন!
ভালো পাঠক হওয়ার ৬টি উপায় আপনার সঙ্গী হয়ে উঠুক।
