বাহিরানা

জেন ক্যাম্পিয়নের দ্য পাওয়ার অব দ্য ডগ: পুরুষালি বনাম বুদ্ধিমান পুরুষ


“যখন আমার বাবার মৃত্যু হয়
সর্বান্তকরণে আমি আমার মায়ের সুখের চাইতে বেশি কিছুই চাইতাম না
কী ধরণের মানুষ হব আমি, যদি আমার মাকেই সাহায্য না করতে পারি?” এই কথা কটি দিয়ে জেন ক্যাম্পিয়নের দ্য পাওয়ার অব দ্য ডগ চলচ্চিত্রটি শুরু হয়। এখানে উল্লেখ্য শেষ বাক্যের মানুষ শব্দের বদলে পরুষ শব্দটিই বেশী মানানসই, পরিচালকও তাই বুঝাতে চেয়েছেন বোধকরি। জেন ক্যাম্পিয়নের নব্য ওয়েস্টার্ন বা রিভিশনিস্ট ওয়েস্টার্ন ঘরানার এই চলচ্চিত্রটি “মাচো ম্যান” নামক ধারণাটির বিভিন্নদিক খতিয়ে দেখা নিয়েই নির্মিত। কে সবচেয়ে সেরা, আক্রমণাত্বক পেশীবহুল পুরুষ? নাকি বুদ্ধিমান— অনেকটা নারীসুলভই যাকে মনে হয়— সেই পুরুষ? একদিক থেকে চলচ্চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে উপরোল্লিখিত প্রশ্নটি। অন্যদিকে চলচ্চিত্রটি প্রতিশোধেরও। আরেকটি তথ্য হলো, জেন ক্যাম্পিয়ন চলচ্চিত্রটি টমাস স্যাভেজের ১৯৬৭ সালের একটি ওয়েস্টার্ন উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করেছেন।

পাশ্চাত্যের সমাজে বর্তমানে মাচো ম্যান ধারণাকে সমালোচনা করা হচ্ছে বিভিন্নভাবে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক মনোবিজ্ঞানে এমনকি পুরুষালি অ্যাগ্রেশন যা কীনা সমাজে পুরুষ হওয়ার পথের একটি প্রাথমিক ধাপ—তার বিরুদ্ধে আলোচনা চলছে। পপুলার বা জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রায় সবখানেই এটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মাচো ম্যানের বিপরীতে কী আসছে? আসছে অনেককিছুই, তবে সেই অনেককিছুর মধ্যে বুদ্ধির প্রাধান্য বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই বুদ্ধিকে বিশেষ করে নারী পরিচালকরা তাদের সিনেমার ধারণা নির্মাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। জেন ক্যাম্পিয়নের সরাসরি বুদ্ধি বনাম মাচো ম্যানের সমান্তরালে সুক্ষ্ণভাবে নারীর ক্ষমতায়নে বুদ্ধির প্রাধান্য নিয়ে গ্রেটা গারউইগের বারবি (২০২৩) চলচ্চিত্রের ক্থা বলা যেতে পারে। দুইজনই কার্যত পুরুষতন্ত্রের সমালোচনাকারী, তাদের মতো করে। পপুলার কালচারে এটা এক বিরাট অগ্রগতি বলা যায়।

দ্য পাওয়ার অব দ্য ডগ-এ বেনেডিক্ট ক্রাম্বারব্যাচের অনবদ্য অভিনয়, এই চলচ্চিত্রকে সেই উচ্চতায় নিয়ে গেছে যেখানে একজন পরিচালক সত্যিই যেতে চান। বেনেডিক্টের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে শক্তিশালী আর প্রভাববিস্তারী অভিনয় বলা যায় একে।

জেন ক্যাম্পিয়নের দ্য পাওয়ার অব দ্য ডগ চলচ্চিত্রের গল্পটি এরকম, ১৯২৫ সালের মন্টানায়, ভিন্নমতাদর্শী দুই ভাই বিত্তশালী রেঞ্চমালিক ফিল বারবাঙ্ক (বেনেডিক্ট ক্রাম্বারব্যাচ) এবং জর্জ বারবাঙ্ক (জেসি প্লেমন্স), যাকে ফিল ফ্যাটসো বলে ডাকে। এক ক্যাটল রাইডের সময় এই দুই ভাইয়ের বিধবা রেস্টুরেন্টমালিক রোজ গর্ডন (কিয়ার্স্টন ডান্স্ট) আর তার ছেলে ম্যাকফি’র (কোদি স্মিথ) সাথে সাক্ষাত্ ঘটে। এর পরই তাদের নিস্তরঙ্গ বা তরঙ্গবহুল পূর্ব জীবন যাই বলা হোক না কেন, সেটা পুরোপুরি বদলে যায়। এর মধ্যে আছে আরেকজন রহস্যময় শিক্ষক, আইকনতুল্য ব্রংকো হেনরি, যার কথা বারে-বার ফিলের কাছ থেকে আমরা শুনতে পাই।

অল্পভাষী জর্জ অনেকদিন রেঞ্চের বাইরে থাকায় ভাইয়ের সাথে তার একটা দুরত্ব তৈরি হয়েছে। ফিলের সাথে ব্রংকো হেনরিও তার কাছে আর সব সাধারণ মানুষের মতই, কিন্তু ফিলের কাছে ব্রংকো হেনরিই সব। তার আদর্শ, প্রতিজ্ঞা, দর্শন— সবই ব্রংকোর কাছ থেকে পাওয়া। ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয় যখন ক্যাটল রাইডের বিরতিতে রেস্টরেন্টে ফিল খাবার টেবিলে অকস্মাৎ শৈল্পিক একটা কাগজের ফুল দেখতে পায়, যা কিনা রোজ গর্ডনের ছেলে ম্যাকফি’র তৈরি, ফিল এই কাগজের ফুলটিকে প্রশংসার ছলে একপর্যায়ে লাইটার দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আর সেটা ম্যাকফি’র সমক্ষেই।

জেন ক্যাম্পিয়নের দ্য পাওয়ার অব দ্য ডগ চলচ্চিত্রে ফিল বারবাঙ্ক এবং ম্যাকফি, প্রথমবার একসাথে হর্স রাইডের সময়
দ্য পাওয়ার অব দ্য ডগ চলচ্চিত্রে ফিল বারবাঙ্ক এবং ম্যাকফি, প্রথমবার একসাথে হর্স রাইডের সময়। Image By Netflix

এখানে বলা প্রয়োজন ম্যাকফি বুদ্ধিদীপ্ত পুরুষের ভূমিকায় আছে এখানে, যে কিনা ফিলের ঠিক উল্টো। তো এই ফুল পুড়ানোর ঘটনায় যে আকস্মিক নাটকীয়তার জন্ম নেয় আর বিধবা রোজ গর্ডন আর তার ছেলের মনে যে আঘাত লাগে, সেটার অবসান ঘটাতে এগিয়ে আসে জর্জ বার্বাঙ্ক। ক্ষতিপূরণস্বরূপ একদিন সে রোজকে বিয়ে করে রেঞ্চে নিয়ে আসে। ম্যাকফি তখন হোস্টেলে। ফিল এই বিয়ে মেনে নিতে পারে না, ফলে সে ক্রমাগত রোজের অনিশ্চয়তাকে বাড়িয়ে তুলতে থাকে, রোজ এই মন:স্তাত্বিক চাপ সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে মদ্যপ হয় পড়ে। তার ছেলে হোস্টেল থেকে ছুটিতে এলে এই সবকিছু দেখতে পায়, তবে প্রতিকারের পথ খুঁজতে খুঁজতেই ফিলের সাথে তার একটা রহস্যময় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এখান থেকেই ঘটনাপ্রবাহ অন্যদিকে মোড় নেয়।

ছবির শেষ অংশটা প্রচলিত অন্যসব চলচ্চিত্র থেকে একদম ভিন্ন, ট্র্যাজিক কিন্তু অন্যরকম এক উপসংহার। ক্যারিশম্যাটিক প্রধান চরিত্র ফিল বারবাঙ্ক এখানে খলনায়ক, কিন্তু মনে রাখতে হবে আর সবার থেকে একটি ব্যক্তিগত বিষয়কে সে আড়াল করে রেখেছে। ভুল বোঝা বা ভুল বুঝানো এক সমাজের প্রতিনিধি এই বারবাঙ্ক, যার ক্ষতগুলোকে ঢেকে রাখতে হয় বন্যতা আর জেদ দিয়ে। আর ম্যাকফি’র মাঝে আমরা দেখতে পাই বিজ্ঞানের আবেগহীন বুদ্ধিদীপ্ত হিংস্রতাকে, যেখানে কোনো অনুকম্পা নেই, সবকিছুই গাণিতিক।

এই দ্বৈরথে প্রেম কি এক অস্ত্র নাকি প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারানোর কৌশল? বন্ধুত্ব নাকি শঠতা? সবকিছুই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আর এই প্রশ্ন থেকে আসা অনিশ্চয়তা দর্শকদের স্তম্ভিত আর বিমূঢ় করে দেয়। সাম্প্রতিক কালের খুব কম চলচ্চিত্রই বন্ধুত্ব, শান্তি, ভ্রাতৃত্ব, প্রতিহিংসা, সমকাম— এসব মানবীয় বিষয়ের এমন গভীর উপস্থাপন করতে পেরেছে। পাওয়ার অব দ্য ডগ-এ বেনেডিক্ট ক্রাম্বারব্যাচের অনবদ্য অভিনয়, এই চলচ্চিত্রকে সেই উচ্চতায় নিয়ে গেছে যেখানে একজন পরিচালক সত্যিই যেতে চান। বেনেডিক্টের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে শক্তিশালী আর প্রভাববিস্তারী অভিনয় বলা যায় একে।

ব্রংকো হেনরির কুকুর মাত্র দুইজনই দেখতে পেয়েছিল, একজন ফিল আর আরেকজন ম্যাকফি। যে কুকুর এই দুই বিপরীত চরিত্রকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। আর ম্যাকফিই প্রথম আবিষ্কার করে যে ব্রংকো আসলে ফিলের প্রেমিক, যেটা কেউ জানে না। সে ফিলের দূর্বলতাকে আবিষ্কার করে ফেলে, পুরুষালি মোড়কে যেটা সে ঢেকে রেখেছে। এর সুযোগ নেয় সে,  তার প্রতি ফিলের প্রেমজ আকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে। চলচ্চিত্রের শুরুতেই এই ভবিষ্যতের ইঙ্গিত রয়ে গেছ: “কী ধরণের মানুষ হব আমি, যদি আমার মাকেই সাহায্য না করতে পারি?”

আরেকটি বিষয় হচ্ছে চলচ্চিত্রের সেট নিউজিল্যান্ডে হলেও মূল ঘটনার কেন্দ্রস্থল ১৯২৫ সালের আমেরিকার মন্টানা। কিন্তু এই সেটে পরিচালক অনবদ্যভাবে মন্টানাকেই ফুটিয়ে তোলেছেন । অনেকগুলো লং শটে, দৃশ্যের পর দৃশ্যে এই চলচ্চিত্র চিরায়ত ওয়ের্স্টানের পুরুষালী চরিত্রের দ্বান্দ্বিকতাকে একদম ভিন্নভাবে উপস্থাপিত করেছে। বেনেডিক্টের অভিনয় সেটাকে আরও বন্য করে তোলেছ। চরিত্রগুলোর মনস্তাত্বিক উত্থান-পতন, শত্রুতা, প্রতিহিংসা, সরলতা— সবই এক কবিতার মতো করে প্রতীকীভাবে উঠে এসেছে। পাহাড়ে এক কুকুরের মতোই ফিলের ক্ষমতা, যার নি:সঙ্গতার, ক্ষতের ভার কেউ নিতে পারে না। ব্রংকো হেনরি তাকে এক পুরুষালী চরিত্রে অভিনয়ের শাস্তি দিয়ে চলে গেছে, পাহাড়ের ওইপারে, চিরতরে। বই থেকে নির্মিত দ্য পাওয়ার অব দ্য ডগ চলচ্চিত্রের রিভিউয়ের সঙ্গে আরো কী কী চলচ্চিত্র বই থেকে নির্মিত হয়েছে তা জানার জন্য পড়তে পারেন সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে উঠুন: বই থেকে বানানো ১৮টি চলচ্চিত্র লেখাটি।

দ্য পাওয়ার অব দ্য ডগ
পরিচালক: জেন ক্যাম্পিয়ন
প্রকাশকাল: ২০২১


মন্তব্য করুন