জয় সেন
“উদ্বেগ” শব্দটি অস্তিত্ববাদে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান বা অর্থ দখল করে আছে, উদ্বেগ থেকেই ব্যক্তির নিজেকে অনুধাবন করা শুরু হয়। যেকোনো পরিবর্তনকে যদি একটি মাত্র শব্দে উল্লেখ করা যায় তাহলে শব্দটি হলো “উদ্বেগ”। রাশিদা সুলতানা’র “শূন্যমার্গে” উপন্যাসটির কেন্দ্রবিন্দু লুকিয়ে আছে সম্পর্কের মাঝে ভর করা সামাজিক আর ব্যক্তিক “উদ্বেগ”-এর মধ্যে। তবে সেটি অস্তিত্ববাদী নয়, তার নিজের মতো। শব্দটিকে খুব ভালোভাবে ভবিষ্যতের সাথে সম্পৃক্ত করা যায়, কেননা ভবিষ্যৎ মানেই অনিশ্চয়তা। অস্ত্বিত্ববাদে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। অবশ্য ফুকো বলেন, মানুষের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া ক্ষমতা দ্বারা নির্ধারিত। তবে যাই বলা হোক না কেন, উদ্বেগ পরিবর্তন ঘটায়, কারণ এটি ধারণ করে বর্তমানকে আরো ভালোভাবে দেখার সংকেত। উপন্যাসটিতে ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সম্পর্কের নিরিখে “উদ্বেগ” প্রতিনিয়ত তার অর্থ বদল করতে থাকে। বহুস্তরে এর উপস্থিতি পাই আমরা, বৈষম্যও কী পরিবর্তনের জন্য উদ্বেগ বয়ে আনে না? তারও উত্তর সন্ধান করা চলে শূন্যমার্গে।
একটি শিল্পোত্তীর্ণ সাহিত্যকর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সেটির নিরপেক্ষতা, মহাভারতের কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস যে নিরপেক্ষতা দেখিয়েছিলেন, আধুনিক কথাসাহিত্যও সেটি মান্য করে। কারণ লেখকের কাজ পক্ষপাতিত্ব নয়, বরং পক্ষগুলোর মনস্তাস্ত্বিক দ্বন্দ্বগুলোকে ইতিহাসের নিরিখে বিশ্লেষণ করা। রাশিদা সুলতানা এক্ষেত্রে খুব ভালোভাবেই সফল, কোনো চরিত্রের প্রতিই তার আলাদা পক্ষপাত নেই।
উপন্যাসটি শুরু হয় শিউলির গায়ে শাল জড়িয়ে বাইরে হাটঁতে বের হওয়ার দৃশ্যবর্ণনার মধ্য দিয়ে। স্থানটি ময়মনসিংহ। ধীরে ধীরে উপলব্ধি হয় হাঁটা দুই ধরণের, আর স্থানও বিবিধ ধরণের। শিউলির হাঁটতে বের হওয়া আসলে তার অতীত থেকে পলায়ন, কিংবা ভবিষ্যৎ? দুই-ই, কারণ সে জানে তার ভবিষ্যৎ ইতোমধ্যেই মুছে গেছে, ফলে সেখানে অনিশ্চয়তা নেই, আছে নিশ্চয়তা, পতনের। ফলে তার চরিত্রটি নিজেকে সময় থেকে মুছে ফেলার বা উদ্বেগহীনতার মধ্যে স্থাপনের উপর দাঁড়িয়ে পড়ে।
সে এমপি গোলাম রশিদের ভাগ্নি। বাবা-মায়ের বিচ্ছিন্নতার পর তার শৈশব কেটেছে মায়ের ফুফাত বোন তসলিমার কাছে বেশ আদর-যত্নে। তার মা তার জন্মের সাত মাস পর মারা যান। তসলিমার ছোটবোনের ছেলে রামিম বাবা-মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসে বছরে এক দুইবার, এই রামিমের সাথে শিউলির, একটি ভুলবোঝাবুঝির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কারণ রামিম তাকে বলে সে তাকে বিয়ে করতে পারবে না, কারণ সে তার বাবাকে ভীষণ ভয় পায়। তার বাবা তাদের সম্পর্ক জানতে পারলে রেগে যাবেন। কিন্তু শিউলি প্রতিরাতেই তার ঘরে আসতে শুরু করে, এটা মেনেই যে রামীম তাকে বিয়ে করবে না। একদিন সে বুঝতে পারে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে, রামিম তার হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে ময়মনসিং শহরের এক ক্লিনিকে পাঠায়, কিন্তু পথিমধ্যে শিউলির টাকা ছিনতাই হয়ে যায়। আর তখনই উপন্যাসে আবির্ভাব ঘটে মিজানের, সে মাদক ব্যবসায়ী। একপর্যায়ে শিউলি তার বাসায় থাকতে শুরু করে, প্রথমে বাচ্চা নষ্ট করার জন্য অনেক চেষ্টা করলেও পরে সে বুঝতে পারে তার ফেরার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। মিজান শিউলিকে রাণীর মতো রাখে, কিন্তু শিউলি কখনওই নিজের শ্রেণী থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, প্রতিবারই তাকে মনে করিয়ে দেয়, তারা ভিন্ন শ্রেণীর, সে এমপির ভাগ্নি আর মিজান প্রায় শ্রেণীহীন। এখানে বলা প্রয়োজন, মিজান চরিত্রটি রহস্যময়, এই রহস্য চরিত্রটিকে অন্য এক মাত্রা দিয়েছে।
শিউলির সাথে মিজানের পার্থক্য, সবই বাহ্যিক। অর্থনৈতিক, সামাজিক, কিন্তু এই শ্রেণীর বাইরে দেখলে তারা দু’জনই এক, প্রত্যেকেই বিদ্রোহী। কিন্তু যেখানে মিজান ভবিষ্যতের আশা হারায়নি, সেখানে শিউলি ভবিষ্যৎ হারিয়ে ফেলেছে। শিউলির প্রতি তার ভালোবাসাও আবার আশাহীন, কারণ শ্রেণী এখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একসময় দৃশ্যপট থেকে শিউলি হারিয়ে যায়, শূন্যস্থানে রামিম ও অন্য নারীরা আসতে থাকে। রামীম এখানে টিপিক্যাল উচ্চশ্রেণীভুক্ত, তবে সে কাপুরুষ, সে শিউলির প্রতি তার ভালোবাসার দায় নিতে পারেনি, ফলে আজীবনের জন্য শূন্যমার্গে আটকে পড়ে। বলা প্রয়োজন, উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই এই শূন্যে আটকে আছে, এর একমাত্র ব্যতিক্রম শুধু শিউলি আর মিজান, তারা শূন্যের মুখোমুখি তাকাবার সাহস অর্জন করেছে, ফলে তারা সেটিকে অতিক্রম করে গেছে বলে বোধ হয়।
আখ্যানভাগটি অন্যদিকে মোড় নেয় বলা যায় একেবারেই ভিন্ন এক উৎসমুখ খুলতে তৎপর হয়—আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি রহস্যাবৃত কালপর্বের মুখোমুখি হই—যখন রামিম আর নাজিয়ার প্রেমের সূত্রে নাজিয়ার ভাই নাফিজের উল্লেখ আসে। সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসার নাফিজের ক্রসফায়ার কাণ্ডের বিষয়টি উত্থাপিত হতে হতেই হঠাৎ বিডিআর বিদ্রোহের বিষয় চলে আসে। এই বিদ্রোহে সেনা অফিসার ও সৈন্যদের মাঝে শ্রেণী বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে এসেছেন রাশিদা সুলতানা—নাজিয়া-নাফিজের বাল্যকালের সখা রাজীবের প্রসঙ্গে। এই বৈষম্যের বিষয়টি সামাজিক পরিসরে অনালোচিত বা ঢাকা তো থাকেই কিন্তু সাহিত্যে প্রায় অনুল্লেখিত। বিদ্রোহের পর, নাফিজ আর রাজীব দুজনেই মৃত্যুবরণ করে। সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরকার বিষয়-আশয় বিশেষ করে বিডিআর বিদ্রোহকে এভাবে বৈষম্যের লেন্সে দেখা বোধহয় “শূন্যমার্গে”ই প্রথম। রাশিদা সুলতানা এখানেও শ্রেণী দ্বন্দ্ব উত্থাপন করতে ভুলেন না।
শিউলি থেকে শুরু হয়ে বিডিআর বিদ্রোহ, মাঝে রামীমের জীবনে আসা নারীরা, এই হলো উপন্যাসটির মহাকাব্যিক আবর্তন।
একটি শিল্পোত্তীর্ণ সাহিত্যকর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সেটির নিরপেক্ষতা, মহাভারতের কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস যে নিরপেক্ষতা দেখিয়েছিলেন, আধুনিক কথাসাহিত্যও সেটি মান্য করে। কারণ লেখকের কাজ পক্ষপাতিত্ব নয়, বরং পক্ষগুলোর মনস্তাস্ত্বিক দ্বন্দ্বগুলোকে ইতিহাসের নিরিখে বিশ্লেষণ করা। রাশিদা সুলতানা এক্ষেত্রে খুব ভালোভাবেই সফল, কোনো চরিত্রের প্রতিই তার আলাদা পক্ষপাত নেই। এখানে শিউলি-রামীমের কথা বলা যায়, শিউলি রামীমকে দোষী সাব্যস্ত করে না কেন? কিংবা রামীম শিউলির সাথে কী আদতেই প্রতারণা করেছে? তা হয়তো নয়, হয়তোবা করেছে। উত্তরটি আমাদের মতো জানতে চরিত্র বিশ্লেষণের একটু গভীরে গিয়ে তাকাতে পারি আমরা— একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবার না পাওয়ায় শিউলির শৈশব ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, আবার অতিরিক্ত রক্ষণশীল পারিবারিক আবহের কারণে রামীমও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
ফলে তাদের দু’জনের ভেতরই মর্ষকাম সৃষ্টি হয়েছে। তাদেরকে আত্মিক শূন্যতা আষ্টেপৃষ্টে গেঁথে ফেলেছে, এটা অপূরণযোগ্য, ফলে ভবিষ্যতহীন একটি সম্পর্কে শিউলির নিজের সমর্পণকে তার আত্মহত্যার পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা যায়। আবার গর্ভপাতের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় তার টাকা হারিয়ে যাওয়াকে অসম্ভব বলেই মনে হয়, কেননা এমপির ভাগ্নি হিসেবে সে শহরের সবকিছুই জানে, না জানাটাই অসম্ভব। তার অবচেতন মৃত্যু এষণা এখানে কাজ করেছে। এরপর মিজানের ঘরে যাওয়া সেটাও তার মৃত্যুচেতনার ইঙ্গিত দেয়। তার সর্বশেষ পরিণতিও তাই রহস্য হিসেবেই রেখে দেন রাশিদা সুলতানা।
অন্যদিকে রামীম ঠিক উল্টো পথ বেছে নিয়েছে। সে তার ‘আমি’কে জীবন্মৃত করে রেখে দিয়েছে, ফলে সে বেঁচে আছে ঠিকই কিন্তু সেটি মৃতের জীবন। লেখিকা আমাদেরকে কোনো সিদ্ধান্তই জানান না, শুধু ঘটনাবলীর মধ্যে চরিত্রদের সিদ্ধান্তগুলোকে আমাদের দেখান— তাও যথেষ্ট শৈল্পিক দূরত্ব বজায় রেখে। ফলে তাদের ভাঙা, অসম্পূর্ণ মনস্তস্ত্ব—ঘটনারাশির ঘূর্ণিতে একটি সম্পূর্ণ জীবনপ্রবাহের জন্ম দেয়, একটি সম্পূর্ণ উপন্যাসের সৃষ্টি করে। আর এসবেব মিলিত প্রবাহে উপন্যাসটি ভাষা ও গঠনকাঠামোতেও প্রথাগত না হয়ে ভিন্ন ও নতুন হয়ে উঠেছে।
তিনি তার নির্মিত চরিত্রদের নিরপেক্ষভাবে দেখেন, এর ফলেই তাদেরকে গভীরভাবে পাঠকদের মনে অনুধাবনযোগ্য করে তোলেন। তা হলো, এই শিউলি, মিজান, রামীম, নাফিজ—তারা প্রত্যেকেই সমাজের কাছে বলি। তারা আজ যা করছে তার কারণ, শ্রেণী শাসিত আধা পুঁজিবাদী, আধা সামন্তবাদী সমাজ। যেখানে বৈষম্য জন্ম দিতে পারে ম্যাসাকারের, বিডিআর থেকে সব আন্দোলনেরই বৈশ্বিক প্রবণতা এটি। এখানে শিউলি আর মিজান সমাজের সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাদের মতো করে, তাই তারা স্মরণীয় ছাপ রেখে যায় উপন্যাসটিতে, আর পাঠকদের মনেও। প্রতিটি চরিত্রই তাদের মতো করে ছাপ রেখে যায়। “শূন্যমার্গেও”।
শূন্যমার্গে
লেখক : রাশিদা সুলতানা
বিষয় : উপন্যাস
প্রকাশকাল : ২০২২
প্রকাশক : পাঠক সমাবেশ
দাম : ৩৫০ টাকা।
বইটি কিনতে চাইলে:
শূন্যমার্গে (Shunnyamarge) – বাহিরানা