বাহিরানা

‘বড় কাগজগুলো আমাকে চেনে না, কলকি দেয় না’- শেখ লুৎফর


কথাসাহিত্যিক শেখ লুৎফর, জন্ম : জয়ধরখালি, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ। তিনি যাপিত জীবনের পরতে পরতে খুঁজে ফেরেন আখ্যান ও আখ্যানের চরিত্র। শেখ লুৎফর রচিত গল্প কিংবা উপন্যাসে ভর করে যেন তাবৎ প্রকৃতি। কেননা, তার রচনার অনুষঙ্গ যাপিত জীবন, যে জীবনে ঘুরছে ফিরছে ছেলেবেলার ময়মনসিংহের গফরগাঁ থেকে আজকের আবাসস্থল সিলেটের সুদীর্ঘ হাওরের অসংখ্য নর-নারী, মানবিকতা-অমানবিকতা, ধর্ম-অধর্ম, সুস্থতা-অসুস্থতা এবং লেখকের পিছু না ছাড়া যৌনতা। ফলে আমরা যখন পাঠ করি তার রচনারাজি, মনে হয় তা যেন আমাদের সমুখে ঘটে যাওয়া ভুখা-নাঙ্গাদের আখ্যান। শেখ লুৎফর-এর প্রকাশিত গ্রন্থ : গল্প: উল্টারথে(২০০৮), ভাতবউ(২০১৩), অসুখ ও টিকনের ঘরগিরস্তি(২০১৭), ফলের নামটি ভুবননটী(২০২৩); উপন্যাস : আত্মজীবনের দিবারাত্রি(২০১১), রাজকুমারী(২০১৯), চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ(২০২৪); কিশোর উপন্যাস : সুতিয়া নদীর বাঁকে, ক্লাস অভ ভূত, সুমাভূতের কাণ্ড। আমার সঙ্গে শেখ লুৎফর-এর সাক্ষাৎকার-এ খোলামেলাভাবে উঠে এসেছে তার সাহিত্যজীবন, প্রথম গল্প, সৃষ্টিশীলতার যাপন ও চিন্তা, এর সবই।


এহসান হায়দার : আপনি গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন কোন সময়ে, সময়টা সম্পর্কে বলবেন?

শেখ লুৎফর : ১৯৯৬ সাল। এক বিকালে হাঁটতে বেরিয়েছি। পথে দেখা হয়ে গেলো কবি মোস্তাক আহমাদ দীন-এর সাথে। হাঁটতে হাঁটতে ভবের বাজার, চামারবাড়ি পেরিয়ে আমরা দলুয়ার হাওরে এসে পড়লাম। দীন ভাই বললেন, এবার ছোটকাগজ ‘বিকাশ’-এর চতুর্থ সংখ্যা হবে গল্পসংখ্যা। কিছুটা অবাক হয়ে আমি পূর্ণচোখে তাকালাম দীন ভাইয়ের মুখের দিকে, বিদগ্ধ কিশোরের ঠোঁটের ওপর একটু একটু গোঁফ উঠছে!

কবি মোস্তাক আহমাদ দীন সম্পাদিত ‘বিকাশ’-এর আগের সংখ্যাগুলোতে আমার কবিতা ছাপা হয়েছে; কিন্তু এখন তো গল্পসংখ্যা…গল্প কীভাবে লেখে? তখন রোজা চলছিল, একদিস্তা কাগজ, বলপয়েন্ট কলম এবং দশটা গোল্ডলিফ কিনে ইফতারির আগেই আস্তানায় ফিরলাম। মনের মধ্যে শুধু এক জিকির-ফিকির, গল্প…।

রাত দশটার পর বিসমিল্লা বলে স্টিলের দরজার লক লাগিয়ে দিলাম। ভিতরে হাহাকার চলছে গল্প…গল্প চাই-ই…। গল্প মানে কাহিনী। আলাপ।

বুঝ-বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে যতরকম অদ্ভুত/আনকমন মানুষ-মানবীকে খুব কাছ থেকে দেখেছি…মাথা থেকে একটা একটা করে নামাতে শুরু করলাম। রাত বারোটার দিকে একটা গল্প পাওয়া গেলো। আমাদের পাড়ার নদীর ঘাটটা ছিল মস্ত বড়। বলতে গেলে ওটা ছিল মেয়েদেরই। ওখানে মেয়েরাই রাজত্ব করতো। দুপুরের দিকে মেয়েদের ভিড় জমে যেতো। তখনও গ্রামের নব্বই ভাগ মেয়ে উৎসব-আয়োজন ছাড়া হামেশা ব্লাউজ পড়ে না। ঘাটের উত্তর দিকে মাটির দেওয়ালের একটা ক্লাবঘর ছিল। গ্রাম্য কোন্দলে ধ্বংসপ্রাপ্ত কিন্তু দেড় হাত চওড়া দেওয়ালগুলো অভিশাপের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুপুরের দিকে মেয়েরা যখন আধা-উলঙ্গ হয়ে গোসলে ব্যস্ত থাকে, তখন গ্রামের তরুণরা এসে দেওয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে নারীর গোপন শরীর দেখতে দেখতে হাত মারে। থকথকে যৌনতা ভরা পুরোটা মেরে দিলাম। নামটা মনে নাই। পরের রাতেও আরেকটা গল্প লিখলাম। আমাদের নদীরঘাটের বেদে-বহরের মেয়ে সুন্দরী, অতৃপ্ত কামনার রাবিকে নিয়ে। নাম ‘সতীর পতি বরুনের বিলাপ’। পরেরদিন সকালেই দীন ভাইয়ের সাথে দেখা করে গল্প দুটো দিয়ে দিলাম। দূর্গাপূজার ছুটি হয়ে গেল। বিকালে ব্যাগ কাঁধে বাস ধরতে ভবের বাজার গেলাম। কবি মঞ্জুর রহমান লেবুর সাথে দেখা। সে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরলো, আপনার দুইটা গল্পের একটা দীন ভাই তার ‘বিকাশ’-এ ছাপবেন।

সময় বলতে তো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা—প্রথম দিকে আমার ‘সময়’ চেতনা প্রচ্ছন্ন ছিল। আসলে ব্যক্তিই তো সময়। গল্পের চরিত্ররাই তো সময় ধরে হাঁটতে শুরু করে। তো সেই সময় একদিকে গণতন্ত্রের লড়াই, রাজনৈতিক গলাবাজি, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীর লাশ পড়ছে। অন্যদিকে গ্রামের অবহেলিত-গরিব নারীরা গার্মেন্টসের চাকরির জন্য ঢাকার দিকে যেতে শুরু করেছে, এনজিও’র মেয়েরা গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের খোঁজ নিচ্ছে, শেখাচ্ছে মায়াবড়ি-সুখীবড়ি কেন খাওয়া জরুরি, কেন একজন মেয়ের লেখাপড়া জানা দরকার, স্বাধীনতা থাকা দরকার। গ্রামের মাটির দালান ভেঙ্গে কেউ কেউ ইটের দালান দিচ্ছে, মাটির সড়কের পাশে ফসলের মাঠের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ ইটভাঁটার কালো চিমনি আকাশের দিকে মুখ তুলতে শুরু করেছে আর জমি-বাড়ি বিক্রি করে কৃষকের অর্ধশিক্ষিত পুত্ররা যাচ্ছে আরবের দেশে। গ্রামের উঁচু ও পতিত ভিটাগুলোতে ১/২টি করে মাথা তুলতে শুরু করেছে পোল্ট্রিখামার। গ্রামের অন্ধকার ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেছে এক নীরব বিপ্লব।

এহসান হায়দার : একটি ঘটনা বা অভিজ্ঞতাকে কি করে আপনি গল্পে রূপান্তর করেন?

শেখ লুৎফর : আমরা প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। প্রায় সব মনিষী শিক্ষার সংজ্ঞাতে ‘জীবনাভিজ্ঞতা’ শব্দটির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলতেই গল্পকার অনেক কিছু দেখতে-শুনতে পান। ছোটগল্প যেহেতু মুহূর্তের চেতনা এবং শুধু একটি মুহূর্ত বা ঘটনাকে সে লক্ষ্যে ধারণ করে তাই কবিতার আত্মার ভগ্নাংশ দিয়ে ছোটগল্পের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা নিরাপদ। এইজন্য চাই ইঙ্গিতধর্মী ও স্থিতিস্থাপক কিছু শব্দ। নকশিকাঁথার মেয়েদের মতো বুননের হাত…বললে অনেক গালগল্প শুরু করা যায় তবে আমার বেলায় সত্যি হলো, আমি নিজেও জানি না। শুধু জানি একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে আমাকে পৌঁছতে হবে। উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো সেই বিন্দুটি লেখার সময় আমার চোখের সামনে দুলতে থাকে। আমার বিশ্বাস, লেখার কৌশল-ভাষা-ভঙ্গি সেই-ই বিন্দুটি বহু দূর থেকে নিয়ন্ত্রন করে কিংবা যোজন-বিয়োজন করিয়ে নেয় মূল গল্পটির।

“চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ” বইয়ের প্রচ্ছদ।
চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ

এহসান হায়দার : কমল চক্রবর্তী সম্পাদিত কৌরব পত্রিকায় আপনার গল্প ছাপা হতো, তখনকার কথা বলবেন?

শেখ লুৎফর : কমল চক্রবর্তী, বারীন ঘোষাল…ওরকম মানুষ হয় না। কোথাকার আমি কে…‘বইপত্র’-এর শুভেন্দু ইমাম বললেন, ‘কৌরবে’ লেখা পাঠান। দীন ভাই কৌরব-এর ঠিকানা দিলেন। ‘পোলিও’ নামে একটা গল্প পাঠালাম। কৌরব-এর ১০৯ সংখ্যায় ছাপা হলো। চিঠি পেলাম বারীন দা’র। পড়তে পড়তে চোখের পাতা ভিজে উঠল, কী আন্তরিক, হৃদয় কত বিশাল! বারীন দা-কমল দা, প্রতি মাসেই একজন না একজনের চিঠি পেতাম। আমি প্রতি মাসেই দুজনকে একটা করে চিঠি লিখি। ২০১১-এর কলকাতা বই মেলায় যাওয়ার জন্য কমল দা দাওয়াত দিলেন। আমার তো পাসপোর্ট-ই নাই। ‘ভাতবউ’ গল্পটা কৌরব-এ ছাপা হওয়ার পর কলকাতার অচেনা কয়েকজন তরুণের উল্লসিত চিঠি পেলাম। অনুমানে বুঝলাম তারা বাম পন্থার মানুষ। লাল সালাম জানিয়ে কমরেড ভাইদের চিঠির জবাব দিয়েছিলাম। ওদিকে কৌরবে আমার গল্পগুলো পড়ে ‘বরেন্দু মণ্ডল’ (যাদপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক) তাঁর গদ্যের বই ‘আখ্যানের আলেখ্য’-তে বাংলাদেশের তরুণদের গল্প নিয়ে আলোচনায় আমার জন্যও দু-চার কথা লিখলেন। বইপত্র লাইব্রেরীতে দীন ভাই বইটা আমাকে দেখালেন। আমি তো অবাক! উনাকে চেনা তো দূর, উনার নামটা তখন পর্যন্ত জানতাম না।

এহসান হায়দার : কবি চন্দ্রাবতীর কাব্যাঞ্চলে আপনার জন্ম, আপনার লেখা উপন্যাসে সেই বিষয় উঠে এসেছে। কেমন লাগে বিষয়টি?

শেখ লুৎফর : হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমিও অবাক হই। ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি নিখাদ গ্রামে আমার জন্ম। এক উন্মুক্ত রঙ্গমঞ্চ। এমনিতেই ময়মনসিংহের মানুষের আবেগ একটু বেশি। ক্রোধ, রাগ-অনুরাগ, প্রেম-প্রণয়, নিষ্ঠুরতাও বেশি বেশি। আধা-উলঙ্গ নর-নারী, গরু-বাছুর, হাঁস-মুরগী, ধান-পাট, কামলা-কামলি…। ঝগড়া-মারামারির সময় পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অশ্লীল গালিগালাজের শিলাবর্ষণ হতো। সম্পূর্ণ কৃষি নির্ভর মানুষগুলো ছিল প্রকৃতির মতো রাখঢাকহীন। নিজের মেয়ে বাসর রাতে স্বামীর সাথে কী করে, তা শুনবার জন্য যুবতী মা ঘরের পিছনের বেড়ায় কান পেতে দাঁড়িয়ে ছিল! পরেরদিন রাত পোহাবার আগেই বিষয়টা গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে যায়। পাড়ার ঘরে ঘরে, মাঠে-ঘাটে বেশ ফুসুরফাসুর, হাসি-তামশা; কিন্তু কেউ-ই জোরে একটা কাশিও দিল না। পাড়ার কোনো তরুণ কৃষক বিয়ে করলো, তো বাসর রাতে সে তার নতুন বউয়ের সাথে কী কী আলাপ ও কর্ম করে তা শোনার জন্য তার বন্ধুরা এসে ঘরের বেড়ায় কান পেতে বসে থাকতো। পরের কয়েকটা দিন মাঠে, খেত-খোলায়, পুকুর ঘাটে-নদীর ঘাটে শুধু এই আলোচনা। নারী-পুরুষ সবার মুখেই হাসি, ফিসফিসানি।

শিক্ষা নাই, ডাক্তার নাই, রোগও নাই। দৈবাৎ কারো কঠিন অসুখ হলো, চিকিৎসা নাই। কবিরাজিই ভরসা। মরবার টাইম হলে তক্তার চাঙ্গে শোয়াইয়া শহরের দিকে যায়। ফিরে আসে মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিয়ে : ‘ডাক্তার কইছে, ভালা-মন্দ খাওয়াইবার…মাত্র একমাস আয়ূ।’

বছর বছর ফিরে আসে কলেরা-বসন্ত তবু মাথার উকুনের মতো মানুষ বাড়ে। কিচ্ছু না থাকলেও তাদের ছিল কিচ্ছা, জারিগান-ঘাটুগান, যাত্রাগান, ফকিরি গান আর বোরো মাসের কীর্তন।

এহসান হায়দার : আপনার গল্প-উপন্যাসে যৌনতা উঠে এসেছে তীব্রভাবে, কথাসাহিত্যে ও কবিতায় যৌনতার এই বিষয়গুলোকে সৃষ্টিশীল অবস্থা থেকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন এবং এর বাস্তবতার ভিত্তিগুলো কেমন হয়ে থাকে?

শেখ লুৎফর : এই প্রশ্নের উত্তর আগের প্রশ্নেই কিছুটা দেওয়া হয়ে গেছে। এবং আলাপচারিতার শুরুর দিকেই বলেছি, আমি নিজের চোখে যা দেখি, তা লিখি। আমরা তখন কলেজে পড়ি; আমাদের গ্রামের এক ধর্মপ্রাণ, বোকা মেয়েকে স্বামী তালাক দিলো। বাপটা ছিল ঘাগু। টাকা পাওয়ার লোভে আদালতে মামলা করলো। ২/৩ বছর পর রায় হলো, জামাইয়ের দশহাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন বছরের জেল। রায় শুনে বোকা মেয়েটি হাকিম সাহেবের এজলাসেই চিৎকার দিয়ে কন্নায় ভেঙে পড়লো, টাকা দিয়া কী হইবো, আমারে যে তিনমাস হেইডা করছে, তার কী হইবো গো আল্লা?

তো আমি এই বিষয় নিয়ে একটা কবিতা লিখলাম :

‘আমারে তালাক দিছে,
হেলিগ্যা আমার কোনো দুক্কু নাই,
আমারে যে হে তিনমাস করছে
তার কী হইবো গো আল্লাহ!’

যৌনতা ছাড়া জীবন নাই। চোখ তুলে প্রকৃতির দিকে তাকালেই আমরা অহরহ দেখতে পাই। সুস্থ-সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য ভাত-মাছ, বাতাস-পানি-এর মতোই যৌনতাও। ফসলের পূর্ণ ফলনের জন্য যেমন ইউরিয়া-টিএসপি লাগে তেমনিই পরিপূর্ণ জীবন রচনার ক্ষেত্রেও যৌনতা।

এহসান হায়দার : একজন কথাসাহিত্যিকের নার্সিসিজম কীভাবে তার সৃষ্টিশীলতায় সাহায্য করে থাকে?

শেখ লুৎফর : চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় নার্সিসিজম একটি মনোরোগ। আমি নিজেকে খুব সাধারণ মানুষ ভাবি। নিঃসঙ্গ, একা এক বাউল। থাকি হাওরের গভীরে। সকাল-দুপুর-রাত, তাকালেই জানালা দিয়ে হাওর আর মস্তবড় আকাশ দেখা যায়। মনটা ডাহুক-কুড়াপক্ষীর ডাক শুনতে শুনতে যখন দমফোট দমফোট লাগে তখন ১০০/২০০ টাকা সম্বল করে বেরিয়ে পড়ি, রানীগঞ্জ, শান্তিগঞ্জ, আক্তাপাড়া… কত কত বাউল বন্ধু। কত কত হাওর! সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা, পলে পলে হাওরের রং বদল হয়, আকাশকে দেখায় ঈশ্বরের মতো বিশাল, মহান ও দরদি! সত্যিই নিজেকে তখন খুব ছোট মনে হয়।

এহসান হায়দার : আপনি প্রেমে পড়েছিলেন?

শেখ লুৎফর : হ্যাঁ। বহুবার; কিন্তু কোনো মেয়েকেই প্রথমে আমি প্রেম নিবেদন করিনি। সে-সুযোগই পাইনি। মেয়েরাই সবসময় আমার পিছনে লেগে থাকতো। এই দৌড়ে অবশ্য মহিলারাই বেশি ছিল। এইজন্য শৈশবে একবার মায়ের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছিলাম। অবশ্য  দোষটা আমার ছিল না। আমাদের পাড়ার এক বড় আপা আমাকে পটিয়েছিলেন। বৃষ্টির দিন। আমরা পাটখেতে ধরা পড়লাম। লোকটা গরুর ঘাসকাটতে গিয়েছিল।

কত প্রেম যে অন্ধ-মাতালের মতো দুপায়ে মাড়িয়ে এসেছি, সাধারণ মানুষ কেউ ভাবতেই পারবে না। আমি ছিলাম গান-কবিতা আর ব্যায়াম ও শরীর গঠনে মগ্ন। ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকেই ঘড়ি ধরে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমাতাম। ভোর পাঁচটা থেকে ব্যায়াম। চার মাইল দৌড়ের পর একশবার বুকডন, একশবার উঠবস। উপন্যাসের মতো বুকস্টলে বুকস্টলে থাকতো ভারতীয় যোগব্যায়ামের বই; গোমুখ আসন, বর্জ্রাসন, উষ্টাসন…বাজি ধরে রসগোল্লা খেতে পারতাম দুই সের। আমার কাছে একফোঁটা বীর্য মানে চল্লিশ ফোঁটা রক্ত! তাই একটা সময় পর্যন্ত নিরুপায় না হলে নারীসঙ্গ করতাম না।

এহসান হায়দার : ত্রৈলক্ষ্যনাথ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, কমলকুমার মজুমদার, আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, মাহমুদুল হক, শহীদুল জহির—এঁদের গল্প এবং উপন্যাসে যে ভিন্নতা, সেটি আপনাকে কীভাবে ভাবায়?

শেখ লুৎফর : তাঁরা আমাদের সাহিত্যের সৈয়দ-মোগল-পাঠান আর খাঁ বংশের ঈশা খাঁ। তাঁরা প্রত্যেকেই যাঁর যাঁর কণ্ঠস্বরে নিজের মনের কথা বলেছেন। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে খাঁটি কথা হচ্ছে নিজ নিজ চিন্তা নিজের স্বরে বলতে চেষ্টা করা। কারণ একজনের হৃদয়-চেতনার সাথে অন্যেরটা মেলে না।

এহসান হায়দার : এদেশে ঢাকাসাহিত্যের যে প্রভাব তা থেকে আপনি দূরে বসবাস করেন, সময় অতিবাহিত করেন বিদ্যায়তনে, অবসরে ঘুরতে যান প্রকৃতির কোলে। আপনার বিচরণ মূলত বাউলদের সাথে। কেমন বোধ করেন সাহিত্যকে এত দূর থেকে?

শেখ লুৎফর : হাওরের পাড়ে বসে ছোটকাগজ, মাসিক ম্যাগাজিন ও বইপত্র যা সামান্য পাই তাতে বিরাট কিছু যে ঘটছে তেমনটা অনুভব করি না। অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ ছিল-আছে। তাঁদের অনেকেরই একটি-দুটি গল্প আজও আমাকে ভাবায়, কাঁপায়। তাঁদের জন্য শুভ কামনা।

আমি মরমিবাদী মানুষ, বাউল চেতনা আমার রক্তে। গত বিশ-বাইশ বছর ধরে সাধুসঙ্গ যাপনের ফলে আমার ব্যক্তি-মানসে ব্যাপক বদল ঘটেছে। সোনার অঙ্গ পুড়ে হয়েছে ছাই। হাওরের পাশে, ছায়াঢাকা বিশাল কোয়ার্টারের রুমে রুমে শান্তিময়-সুন্দর নিঃসঙ্গ বেঁচে থাকা, প্রতিটি মুহূর্তকে নিজের চেতনা দিয়ে চিহ্নত করা।

আজ আমি নিজের জীবন ও কর্মকে অন্যের সাথে তুলনা করি না। বিনয়ের সঙ্গে বলছি, আমি সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি গালভরা শব্দ দ্বারা নিজেকে চিহ্নিত করি না। আমি নিরুপায় হয়ে লিখি এবং শুধু নিজেকে লিখি।

এহসান হায়দার : প্রত্যেক লেখকের প্রবণতা থাকে নিজস্বতা তৈরি করার, বিগত তিন দশকের গল্পকারদের সঙ্গে যদি আপনার গল্পের পার্থক্য করেন, সেখানে আপনার নিজস্বতা কতটা?

শেখ লুৎফর : যেহেতু একটু বেশি বয়সে গল্প লিখতে বসেছিলাম তাই প্রথম গল্প থেকেই চেষ্টা ছিল নিজের স্বরটি লক্ষ্যভেদী করে তুলবার। তাইতো প্রথম গল্পের প্রথম লাইনটাই শুরু করেছিলাম : ‘গেরাম ঘুরতে ঘুরতে বেলা পড়ে যায়, বেসাত মন্দ হয় না। তবু বহরে ফেরার তাগদা নাই নিশির।’ (গল্প: নিশি) নিজস্বতা ধরে রাখার জন্য এখনও খুব সচেতন ভাবে ময়মনসিংহ-সিলেটের আঞ্চলিক শব্দগুলো ডায়ালগে ব্যবহার করি।

হাওরের এককোনায় পড়ে থাকা মানুষ আমি পরমাত্মায় বিশ্বাসী। আমার ভাব-গুরু বাউল মকদ্দস আলম উদাসি। তাই নিজের বিষয়ে আমি কোনো তুলনামূলক আলোচনায় নাই।

এহসান হায়দার : লেখকের নিজস্ব ভাষা থাকতে হয়, ভাষার সন্ধান এবং সৃষ্টিশীলতার আকাঙ্ক্ষা আপনাকে কতটা রাজনৈতিক জ্ঞান পেতে সাহায্য করে?

শেখ লুৎফর : কত শত শত রাত যে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি, লেখা শেষ করে গভীর রাতে ঘুমাতে এসেছি; কিন্তু মাথা থেকে চরিত্র নামছে না। একবার রাত একটায় ঘুমালাম। ঘুম ভাঙল তিনটায়। একদম চনমনে দেহমন, মাথায় আস্ত একটা গল্প কিলবিল করছে। পরেরদিন সকাল নয়টা পর্যন্ত টানা লিখে শেষ করলাম। নাম দিলাম ‘ঈশ্বরের লাল চোখ’।

আমাদের এখানে রাজনীতি এত প্রকট যে, সচেতন হওয়া ছাড়া উপায় নাই। বিশ্বসাহিত্যের সেরা ক্লাসিকগুলোর শিরায় শিরায় রাজনীতি। লেখক রাজনীতি সচেতন না হলে লেখা বিকলাঙ্গ হওয়ার ভয় থাকে।

ভাষার বিষয়ে আগের প্রশ্নে কথা হয়েছে। এখন হলো সৃষ্টিশীলতা…এইগুলো হচ্ছে প্রবণতা, টেকনিক। যদি চরিত্রের সাথে আত্মিক টান থাকে তাহলে চরিত্র নিজেই লেখককে পথ বাতলে দেয়, উপযুক্ত উপমা ও শব্দ বাছাই করে দেয়। একেই বলে সৃষ্টিশীলতা। এই গল্প-চরিত্র-ভাষা কোনোটাই অন্য কারো মতো হবে না। এটা হবে শুধু আপনার মুখ ও হৃদয়ের ছবি।

এহসান হায়দার : আপনি কোন কোন কবির কবিতা পড়তে ভালোবাসেন, যাদের উপমা কখনও কখনও নিজের অবচেতনে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে গল্প-উপন্যাসে?

শেখ লুৎফর : যৌবনে বেশি পড়তাম জীবনানন্দকে। এখন সারা বছর ঘুরে-ফিরে পড়ি বিনয়-শক্তি, সমর সেন, মণীন্দ্র গুপ্ত এবং হঠাৎ হঠাৎ সুনীল। নব্বই দশকের ২/১ জন কবির কবিতা এখনও আমাকে গভীরভাবে টানে। বর্তমানের অনেক তরুণ কবির কবিতা মন দিয়ে পড়ি। ভালো লাগে।

এহসান হায়দার : আপনার প্রিয় লেখকদের নামগুলো বলবেন, কেন ভালো লাগে?

শেখ লুৎফর : ঈশ্বর গুপ্ত, মানিক-বিভূতিভূষণ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ইলিয়াস—বাংলাসাহিত্যে আমার প্রিয় জীবিত লেখকদের নাম আমি বলবো না। নিরাপদ না। বিশ্বসাহিত্যে গোগোল, চেখভ, শলোখভ, হেমিংওয়ে, টমাস মান, নাগিব মাহফুজ। উর্দু গল্পকার মান্টো, কৃষণ চন্দর এবং মালায়ালম ভাষার ভৈকম মুহম্মদ বশীর।

এহসান হায়দার : আপনি দীর্ঘদিন যাবৎ বাউল-সঙ্গ, সাধু-সঙ্গ করছেন, তাঁদের চেতনা, পথ ও বোধ আপনাকে স্পর্শ করে নিশ্চয়ই। বাউল জীবন আপনার লেখায় কীভাবে আনতে চান?

শেখ লুৎফর : নিত্যদিনকার জীবন-যাপনে যে বোধ-প্রজ্ঞা কাজ করে, যে চেতনাটা আপনাকে অবচেতনে এগিয়ে যেতে সাহস যোগায়, যে সত্যটি আপনার জীবনের অংশ হয়ে গেছে। সেটিকে পরিকল্পিতভাবে লেখায় আনার চেষ্টা করতে হয় না। সে আপনা-আপনিই আসে। একটা কথা আছে না, মহৎ হৃদয় ছাড়া মহৎ কিছু সৃষ্টি হয় না।

এহসান হায়দার : প্রচলিত জনপ্রিয়ধারায় না লিখে আপনি একধরণের সাধক জীবনে বিশ্বাসী, ছোটকাগজেই স্বচ্ছন্দ্য/স্বাচ্ছন্দ্য, বিস্তারিত বলবেন কি?

শেখ লুৎফর : লেখালেখি শুরু করেছিলাম ছোটকাগজে। নতুন লিখতে আসা মানে নিরীক্ষা আর নিরীক্ষা, ছোটকাগজ ছাড়া কে আশ্রয় দেবে? এদেশে এত সাহস কার বুকে—হ্যাঁ? আমার বেলায় গিঁট্টু অন্যখানে। বড় কাগজগুলো আমাকে চেনে না, কলকি দেয় না। তাই আজও এই চরম মিডিয়াবাজীর সময়ে আমি শুধু ছোটকাগজে লিখেই সন্তুষ্ট।

এহসান হায়দার : সাহিত্যের কোনদিকগুলির প্রতি আপনি বিশেষভাবে মনোযোগী?

শেখ লুৎফর : কবিতা। গল্প লেখার জন্য আমি দেশি-বিদেশি প্রচুর কবিতা পড়ি, নিজেও লিখতে চেষ্টা করি। আনন্দ পাই। সবচেয়ে বেশি সুখ পাই রাশান গল্প-উপন্যাস পড়ে আর বাউলদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য হাওরের পরতে পরতে ঘুরে। যখন নাটক-সিনেমা দেখা শুরু করি তখন লেখা-পড়া, ভ্রমণ সব বন্ধ। এইসব করে করে আমি গল্পকে ভুলে থাকতে চাই। আসলে এইসবই হচ্ছে আমার গল্প লেখার প্রস্তুতি।

এহসান হায়দার : নতুন যারা লিখছেন, আপনার পাঠের জায়গা থেকে তাদের রচনাকে কীভাবে সমৃদ্ধ করতে বলবেন?

শেখ লুৎফর : ভ্রমণ, পঠন-পাঠন, বাস্তবের ব্যক্তি-চরিত্রগুলো, সেটা আমাদের ঘর কিংবা পাশের বাড়ির মানুষও হতে পারে। লোকটার আচরণগত বৈশিষ্টের সাথে তার মানসিক অবস্থা বিবেচনায় থাকা উচিত। তার কান্না, হাসি-রাগ, কথা বলা, থুতু ফেলার ভঙ্গি—লেখার সময় লেখক চরিত্রের অন্তর-বাহির যতটা স্পষ্ট অনুভব করতে পারবেন, পাঠকও বইয়ের পাতার চরিত্রের মধ্যে ততটাই দেখতে পাবেন নিজের চেহারা, সমাজ-রাষ্ট্র। তা না হলে শত চেষ্টা করলেও চরিত্র আর আপন গতিতে এগিয়ে যাবে না। গল্প হয়ে যাবে কৃত্রিম।

(Visited 140 times, 140 visits today)

1 thought on “‘বড় কাগজগুলো আমাকে চেনে না, কলকি দেয় না’- শেখ লুৎফর”

Leave a Comment